ঢাকা ০৬:১৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ট্রাষ্টের মাসবপ্যাপী সেহরি বিতরণ চলমান তেলাপোকার উপদ্রব কমাতে যা করবেন এক ঘণ্টায় ৩০ বার বিমান হামলা গাজায় রিউমার স্ক্যানার ‘হাসিনা এখনো প্রধানমন্ত্রী’, এমন কথা বলেননি ট্রাম্প অতিরিক্ত আইজিপি হলেন এসএমপি কমিশনার সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ মামলায় ২’জনের সাক্ষী অযত্নে ধুঁকছে পল্লী-কবি জসীমউদ্দীন জাদুঘর সিলেটে যেভাবে ইসলাম প্রচার করেছেন হজরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.) সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির মানববন্ধন সিলেটে থেকে প্রত্যাহার হলেন ২ থানার ওসি হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সেনা-পুলিশের টহলে পালিয়েছে দালাল চক্র

এই নগরীর ইতিহাস জানতে ১৫০ বছর ধরে খননকাজ চলছে, লাগবে আরও ১৫০ বছর

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৬:৫৭:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩ ১৪৪ বার পড়া হয়েছে

তানজিনা হোসেন,চিকিৎসক ও কল্পবিজ্ঞান লেখক

ট্রয় নগরীতে খননকাজের পর বেরিয়ে আসছে আদি ইউরোপীয় সভ্যতার সূচনালগ্নের আশ্চর্য সব ইতিহাস
ট্রয় নগরীতে খননকাজের পর বেরিয়ে আসছে আদি ইউরোপীয় সভ্যতার সূচনালগ্নের আশ্চর্য সব ইতিহাস। ছবি: লেখক

সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়তে হলো।যেতে হবে প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের ওপর পথ,তুরস্কের একেবারে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে,মারমারা সাগরের দারদানেলেস অংশের তীরে অবস্থিত চানাক্কেলে বা কানাক্কেলে অঞ্চলে।তুর্কি ভাষায় কানাক মানে পট বা হাঁড়ি, কেলে অর্থ দুর্গ।পটারিশিল্পের জন্য এককালে বিখ্যাত ছিল এই অঞ্চল, সে জন্য এই নাম।পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এলাকাটি হয়ে ওঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা যাঁরা সূর্যোদয়ের আগেই ইস্তাম্বুল ছেড়ে যাচ্ছি, তাঁদের চানাক্কেলে যাওয়ার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমরা চলেছি মহাকাব্যবিখ্যাত এক নগরীর খোঁজে।১৮৭০ সালে চানাক্কেলের ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং ইজিয়ান সাগরের ৬ কিলোমিটার পূর্বে প্রাচীন এই নগরী খুঁজে পান জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হেনরিখ শেইলম্যান। খননকাজ করার সময়ই দুনিয়াজুড়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে তোলপাড় পড়ে যায়। কারণ, অচিরেই প্রমাণিত হয় যে এই সেই হারিয়ে যাওয়া ট্রয় নগরী, ইলিয়াড-ওডিসিতে যার উত্থান ও পতনের চমকপ্রদ কাহিনি বয়ান করে গেছেন গ্রিক কবি হোমার।এতকাল ভাবা হতো এ কেবলই কবির কল্পনা,আদতে সত্য নয়।

ট্রয়ের সেই বিখ্যাত ঘোড়ার রেপ্লিকা। ছবি: লেখক

কিছুকাল পর ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের প্রাসাদ ও মূল্যবান সব ধনরত্নও খুঁজে পান হেনরিখ। ট্রয় তাহলে সত্যিই ছিল! ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেন,যে হেলেনকে নিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চলেছিল সে যুদ্ধ, আর শেষ পর্যন্ত গ্রিকদের চাতুর্য ও প্রতারণার শিকার হয়ে ধ্বংস হয়েছিল একটি প্রাচীন সভ্যতা। এই আবিষ্কার মানবসভ্যতার বিকাশের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। হেনরিখ পরবর্তী দেড় শ বছরে বেরিয়ে আসতে থাকে ট্রয় নগরীর স্তরের পর স্তর,এখনো চলছে সেই খননকাজ, বেরিয়ে আসছে আদি ইউরোপীয় সভ্যতার সূচনালগ্নের আশ্চর্য সব ইতিহাস।ইস্তাম্বুলের অলিগলি পেরিয়ে আমাদের ভ্যান যখন হাইওয়েতে পড়েছে, পাহাড়ের আড়াল থেকে সূর্য তখন উঁকি দিচ্ছে। দিনটা চমৎকার সোনালি, মারমারা সাগরের গাঢ় নীল জলে সূর্যের আলোর ঝিকিমিকি। পথের দুই ধারে জলপাই আর কমলার বাগান। আমাদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা।যেমনটা সেদিন উত্তেজিত আর অস্থির হয়েছিলেন তিন গ্রিক দেবী অ্যাথেনা,আফ্রোদিতি ও হেরা। মেষপালক কিন্তু আদতে ট্রয়ের হারিয়ে যাওয়া রাজপুত্র প্যারিস কাকে দেবে সেই মহার্ঘ্য আপেল,কে পাবে ত্রিভুবনের সবচেয়ে সুন্দরী দেবীর তকমা? কাকে বেছে নেবেন প্যারিস? জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা,ক্ষমতার দেবী হেরা নাকি প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি?

কত মৃত্যু, কত ধ্বংস, কত যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আছে এই প্রাচীন নগরী।ছবি: লেখক

হোমার বর্ণিত ট্রয় নগরী সে সময়কার সবচেয়ে শক্তিধর, ধনী আর দৃষ্টিনন্দন শহর। উঁচু একটা পাহাড়ের ওপরে ছিল এই নগরী, চারদিক পাথরের দেয়ালে ঘেরা। সুরক্ষিত ও প্রায় অজেয় এক শহর। শহরে প্রবেশপথে ছিল বিশাল সব গেট, কাঠের তৈরি, যেগুলো বন্ধ করা যেত। ছিল প্রশস্ত সব রাস্তা, বর্গাকার ডিজাইনের পাথরের বাড়িঘর।বাড়িতে জানালা ও দরজার ব্যবহার মানবসভ্যতায় প্রথম ট্রোজানরাই শিখেছিল। তারা শিখেছিল মৃৎশিল্প, আধুনিক স্থাপত্যরীতি, নগর পরিচালনা। যুদ্ধকৌশলে তারা ছিল দুনিয়ার সেরা। ধনসম্পদেও অতুলনীয়। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় ছিল দেবী অ্যাথেনার মন্দির আর রাজা প্রায়ামের অপূর্ব প্রাসাদ। প্যারিস যখন স্পার্টা থেকে রাতের অন্ধকারে হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে এলেন, হেলেনের স্বামী স্পার্টার রাজা মেনেলাউস এবং তার ভাই আগামেমনন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে নৌবহর নিয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে এই নগরের পাশে স্কামান্দার নদীর মুখে এসে তাঁবু গেড়েছিলেন।তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন গ্রিস বা আচিয়ানদের বন্ধুপ্রতিম সব রাজ্যের রাজা।চানাক্কেলে শহরের মাঝখানে বা সিটি সেন্টারে রয়েছে ট্রয়ের সেই বিখ্যাত ঘোড়ার একটি রেপ্লিকা।

গ্রিস-ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়ে ব্র্যাড পিট অভিনীত চলচ্চিত্র ট্রয়-এ ব্যবহারের জন্য এই ঘোড়াটি নির্মিত হয়েছিল। সাড়ে ১২ মিটার উঁচু, প্রায় ১২ টন ওজনের স্টিলের তৈরি এই বিশাল ঘোড়া পরে তুরস্ক সরকারকে দিয়ে দেয় ওয়ার্নার ব্রাদার্স। আসল ট্রয় নগরে ঢোকার আগে পর্যটকেরা আগে এই ঘোড়ার সঙ্গে ছবি তুলে নেন। ঘোড়াটার পাশেই প্রাচীন ট্রয়ের একটি সম্ভাব্য নকশা, কীভাবে এই নগরী বহিঃশত্রুদের হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষা করত, এই নকশা দেখলে কিছুটা বোঝা যায়। এমনই দুর্ভেদ্য নগরী ছিল ট্রয় যে গ্রিকরা ৯ বছর চেষ্টা করেও নগরীতে প্রবেশ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এই বিশাল ঘোড়াটিকে দেবী অ্যাথেনার আশীর্বাদ হিসেবে উপঢৌকন পাঠানো হয় ট্রয়কে, তার আগে শত শত গ্রিক জাহাজ ইজিয়ান সাগর ছেড়ে চলে যায়, যেন যুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধ জেতার আনন্দে ঘোড়াটাকে ভেতরে নিয়ে যায় ট্রয়বাসী। তারপর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ঘোড়ার পেটথেকে একে একে বেরিয়ে আসে গ্রিকরা, নগরদ্বার খুলে দেয়, যা দিয়ে প্রবেশ করে ফিরে আসা জাহাজের সব সশস্ত্র সৈন্য। আর নৃশংসভাবে তারা হত্যা করে ট্রয়ের রাজা-রানিসহ সবাইকে, আগুনে পুড়িয়ে দেয় এই অনিন্দ্যসুন্দর নগরীকে। ঘোড়ার মূর্তি থেকে আধঘণ্টা দক্ষিণে গেলেই সত্যিকারের ট্রয় নগরী।

প্রত্নতত্ত্ববিদ হেনরিখ শেইলম্যান খননকাজের সময় বুঝতে পেরেছিলেন যে এখানে কেবল একটি নয়,আছে প্রায় ৯টি ট্রয়। মানে এই নগরী বহুবার আক্রান্ত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে, কখনো শত্রুদের দ্বারা, কখনো ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, তারপর আবার পুনর্নির্মিত হয়েছে। ট্রয়ের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে এ ধারণার প্রমাণ মেলে। একেবারে ওপরে বা বাইরের দিকে যে পাথরের নির্মিত দেয়াল বা বাড়িঘরের অবশিষ্ট দেখা যাবে,তা আসলে নবম ট্রয়ের। এটি রোমানদের তৈরি। কারণ, রোমানদের ঐতিহ্যবাহী আগোরা, থিয়েটার এবং পাবলিক বিল্ডিংয়ের অবশিষ্ট দেখা যাবে এখানে। এই অংশটুকু, ইতিহাসবিদদের ধারণা, ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তৈরি।তবে যতই ভেতর দিকে যাবেন, স্তরের পর স্তর আবিষ্কৃত হতে থাকবে। এ যেন বৃত্তের বাইরে আরেকটা বৃত্ত, তার বাইরে আরেকটা বৃত্ত। একেবারে ভেতরের স্তরটি হলো প্রাচীন ট্রয়। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় যে এখানকার লাইম স্টোনের তৈরি দেয়াল এবং চারকোনা ঘরের ধ্বংসস্তূপগুলো খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছরের পুরোনো।

মানে ব্রোঞ্জ সভ্যতার শেষ দিককার কথা। কথিত আছে যে গালপিনার ও কুমতেপে এলাকার কিছু মানুষ এখানে এসে প্রথম বসত গড়ে। প্রথম ট্রয় দুর্ঘটনাবশত আগুনে পুড়ে গেলে এখানকার অধিবাসীরা আরও আধুনিক ও আরও বৃহদাকারে তাদের নগরী গড়ে তোলে, যাকে বলা হয় দ্বিতীয় ট্রয়। অচিরেই এটি হয়ে ওঠে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনস্থল। আনাতোলিয়া ও মেডিটেরিনিয়ান সভ্যতার ঠিক সংযোগস্থলে অবস্থিত এই নগরে খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে যে বিশালাকার পাথরের দেয়াল, সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের বিরাট চত্বর, ম্যাজারোন আকৃতির ঘরবাড়ি, বিরাট প্রতিরক্ষা দরজা বা গেটের অবশিষ্টের দেখা মেলে তা সত্যি আশ্চর্য করে। ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া নিদর্শন প্রমাণ করে, সেই সময়ও ট্রোজানরা পটারির কাজ করত। পটারিশিল্পে ব্যবহার করার জন্য অ্যাম্বার রং আসত বাল্টিক এলাকা থেকে, ভারত থেকে আসত লাল খনিজ কার্নেলিয়ন আর আফগানিস্তান থেকে আসত ল্যাপিস। সুপ্রাচীন এই জাতি যে ধনী, শৌখিন ও সৌন্দর্যপ্রিয় ছিল, তা এখানকার নিদর্শনগুলো থেকে বোঝা যায়।

হেনরিখ প্রথমে ভেবেছিলেন যে দ্বিতীয় ট্রয়ই হোমার-বর্ণিত ট্রয়। কিন্তু পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। কিছু নিদর্শন প্রমাণ করে যে এটি মাইসিনিয়ান গ্রিকদের আগমনেরও এক হাজার বছর পুরোনো সভ্যতা। কাজেই এটাই সেই ট্রয়, যাকে গ্রিকরা আক্রমণ করেছিল, এই অনুমান বাতিল হয়ে যায়। আসলে গ্রিক ও ট্রোজানদের মধ্যে যুদ্ধটা হয়েছিল ষষ্ঠ ও সপ্তম ট্রয়ে। এর স্থাপত্যরীতির সঙ্গে হোমারের বর্ণনা মেলে। তা ছাড়া এর ধ্বংসস্তূপে ভয়াবহ যুদ্ধ বা আক্রমণের নিদর্শনও পাওয়া যায়। তবে অনেক ইতিহাসবিদেরই ধারণা, ট্রয়ের ঘোড়ার অংশটুকু আসলে হোমারের কল্পিত, এমন কোনো ঘটনা যুদ্ধের সময় ঘটেনি। ট্রয় আসলে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।ব্রোঞ্জ আমলের ট্রয় থেকে সর্বশেষ রোমান ট্রয় পর্যন্ত এক আশ্চর্য ঐতিহাসিক যাত্রা সমাপ্ত করার পর চার হাজার বছর পুরোনো এই সভ্যতা আমাদের আপ্লুত করে। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দৃষ্টিসীমায় দেখা যায় ইজিয়ান সাগর, যা এখন অনেক দূরে চলে গেছে, সেই স্কামান্দার নদীও গেছে শুকিয়ে। এই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের বারান্দা থেকেই বৃদ্ধ রাজা প্রায়াম ও রানি হেকুবা দেখেছিলেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় পুত্র হেক্টরের মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একিলিস। আর ট্রয়ের পতনের দিন এই প্রাসাদেই বীর ও প্রায় অমর একিলিস গোড়ালিতে তিরবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই উপত্যকা আর পাহাড় এমন কত মৃত্যু, কত ধ্বংস, কত যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আছে!

ট্রয় নগরীতেছবি: লেখকের সৌজন্যে

১৮৭০ সাল থেকে ২৪টি খনন কোম্পানি প্রায় দেড় শ বছর ধরে খননকাজ চালিয়ে যা আবিষ্কার করেছে, তা অবিশ্বাস্য এক সমৃদ্ধ জাতির ইতিহাস বহন করে। বলা হয়, ট্রয়ের ইতিহাসের আরও ৭০ শতাংশ এখনো মাটির নিচেই রয়ে গেছে। এগুলোকে বের করে আনতে হয়তো আরও দেড় শ বছর লেগে যাবে। বর্তমানে ট্রয়ের খননকাজ পরিচালনা করছেন চানাক্কেলে অনসেকিজ মার্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ রুস্তম আসলান। তাঁর দলই প্রমাণ করে যে ট্রয় আসলে হোমারের বর্ণিত ট্রয়ের চেয়েও প্রাচীন, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগে এই নগরের পত্তন হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এই জায়গাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে ইউনেসকো।

ট্রয় দেখা শেষ করে খানিক দূরে দেবী অ্যাথেনার মন্দির দেখতে গেলাম। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কয়েকটি সুউচ্চ পিলার এখনো অবশিষ্ট আছে। জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা ট্রোজান ও গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী ছিলেন। কিন্তু সৌন্দর্য বিবেচনায় প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির কাছে পরাজিত হওয়ার কারণে ট্রয়বাসীকে ছেড়ে গ্রিকদের পক্ষ নেন অ্যাথেনা। স্বর্গীয় আপেলের বিনিময়ে প্যারিসকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জ্ঞান ও বিদ্যায় ভূষিত করবেন বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন অ্যাথেনা। দেবী হেরা বলেছিলেন তিনি তাঁকে দেবেন শক্তি ও ক্ষমতা। কিন্তু আফ্রোদিতি বলেছেন তিনি প্যারিসকে দেবেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুন্দরী নারীর প্রেম। প্যারিস সবকিছুর চেয়ে ভালোবাসা ও প্রেমকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ভুল করেছিলেন কি? যে ভুলের মাশুল তাঁর স্বজাতিকে দিতে হয়েছিল নৃশংস বিলুপ্তির মাধ্যমে? কে জানে! বোধ করি, দেবতা আর মানুষে এটাই বড় পার্থক্য। মানুষ ভালোবাসার জন্য সব ঝুঁকি নিতে পারে। দেবতারা পারে না।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

এই নগরীর ইতিহাস জানতে ১৫০ বছর ধরে খননকাজ চলছে, লাগবে আরও ১৫০ বছর

আপডেট সময় : ০৬:৫৭:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩

তানজিনা হোসেন,চিকিৎসক ও কল্পবিজ্ঞান লেখক

ট্রয় নগরীতে খননকাজের পর বেরিয়ে আসছে আদি ইউরোপীয় সভ্যতার সূচনালগ্নের আশ্চর্য সব ইতিহাস
ট্রয় নগরীতে খননকাজের পর বেরিয়ে আসছে আদি ইউরোপীয় সভ্যতার সূচনালগ্নের আশ্চর্য সব ইতিহাস। ছবি: লেখক

সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়তে হলো।যেতে হবে প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের ওপর পথ,তুরস্কের একেবারে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে,মারমারা সাগরের দারদানেলেস অংশের তীরে অবস্থিত চানাক্কেলে বা কানাক্কেলে অঞ্চলে।তুর্কি ভাষায় কানাক মানে পট বা হাঁড়ি, কেলে অর্থ দুর্গ।পটারিশিল্পের জন্য এককালে বিখ্যাত ছিল এই অঞ্চল, সে জন্য এই নাম।পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এলাকাটি হয়ে ওঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা যাঁরা সূর্যোদয়ের আগেই ইস্তাম্বুল ছেড়ে যাচ্ছি, তাঁদের চানাক্কেলে যাওয়ার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমরা চলেছি মহাকাব্যবিখ্যাত এক নগরীর খোঁজে।১৮৭০ সালে চানাক্কেলের ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং ইজিয়ান সাগরের ৬ কিলোমিটার পূর্বে প্রাচীন এই নগরী খুঁজে পান জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হেনরিখ শেইলম্যান। খননকাজ করার সময়ই দুনিয়াজুড়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে তোলপাড় পড়ে যায়। কারণ, অচিরেই প্রমাণিত হয় যে এই সেই হারিয়ে যাওয়া ট্রয় নগরী, ইলিয়াড-ওডিসিতে যার উত্থান ও পতনের চমকপ্রদ কাহিনি বয়ান করে গেছেন গ্রিক কবি হোমার।এতকাল ভাবা হতো এ কেবলই কবির কল্পনা,আদতে সত্য নয়।

ট্রয়ের সেই বিখ্যাত ঘোড়ার রেপ্লিকা। ছবি: লেখক

কিছুকাল পর ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের প্রাসাদ ও মূল্যবান সব ধনরত্নও খুঁজে পান হেনরিখ। ট্রয় তাহলে সত্যিই ছিল! ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেন,যে হেলেনকে নিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চলেছিল সে যুদ্ধ, আর শেষ পর্যন্ত গ্রিকদের চাতুর্য ও প্রতারণার শিকার হয়ে ধ্বংস হয়েছিল একটি প্রাচীন সভ্যতা। এই আবিষ্কার মানবসভ্যতার বিকাশের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। হেনরিখ পরবর্তী দেড় শ বছরে বেরিয়ে আসতে থাকে ট্রয় নগরীর স্তরের পর স্তর,এখনো চলছে সেই খননকাজ, বেরিয়ে আসছে আদি ইউরোপীয় সভ্যতার সূচনালগ্নের আশ্চর্য সব ইতিহাস।ইস্তাম্বুলের অলিগলি পেরিয়ে আমাদের ভ্যান যখন হাইওয়েতে পড়েছে, পাহাড়ের আড়াল থেকে সূর্য তখন উঁকি দিচ্ছে। দিনটা চমৎকার সোনালি, মারমারা সাগরের গাঢ় নীল জলে সূর্যের আলোর ঝিকিমিকি। পথের দুই ধারে জলপাই আর কমলার বাগান। আমাদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা।যেমনটা সেদিন উত্তেজিত আর অস্থির হয়েছিলেন তিন গ্রিক দেবী অ্যাথেনা,আফ্রোদিতি ও হেরা। মেষপালক কিন্তু আদতে ট্রয়ের হারিয়ে যাওয়া রাজপুত্র প্যারিস কাকে দেবে সেই মহার্ঘ্য আপেল,কে পাবে ত্রিভুবনের সবচেয়ে সুন্দরী দেবীর তকমা? কাকে বেছে নেবেন প্যারিস? জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা,ক্ষমতার দেবী হেরা নাকি প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি?

কত মৃত্যু, কত ধ্বংস, কত যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আছে এই প্রাচীন নগরী।ছবি: লেখক

হোমার বর্ণিত ট্রয় নগরী সে সময়কার সবচেয়ে শক্তিধর, ধনী আর দৃষ্টিনন্দন শহর। উঁচু একটা পাহাড়ের ওপরে ছিল এই নগরী, চারদিক পাথরের দেয়ালে ঘেরা। সুরক্ষিত ও প্রায় অজেয় এক শহর। শহরে প্রবেশপথে ছিল বিশাল সব গেট, কাঠের তৈরি, যেগুলো বন্ধ করা যেত। ছিল প্রশস্ত সব রাস্তা, বর্গাকার ডিজাইনের পাথরের বাড়িঘর।বাড়িতে জানালা ও দরজার ব্যবহার মানবসভ্যতায় প্রথম ট্রোজানরাই শিখেছিল। তারা শিখেছিল মৃৎশিল্প, আধুনিক স্থাপত্যরীতি, নগর পরিচালনা। যুদ্ধকৌশলে তারা ছিল দুনিয়ার সেরা। ধনসম্পদেও অতুলনীয়। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় ছিল দেবী অ্যাথেনার মন্দির আর রাজা প্রায়ামের অপূর্ব প্রাসাদ। প্যারিস যখন স্পার্টা থেকে রাতের অন্ধকারে হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে এলেন, হেলেনের স্বামী স্পার্টার রাজা মেনেলাউস এবং তার ভাই আগামেমনন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে নৌবহর নিয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে এই নগরের পাশে স্কামান্দার নদীর মুখে এসে তাঁবু গেড়েছিলেন।তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন গ্রিস বা আচিয়ানদের বন্ধুপ্রতিম সব রাজ্যের রাজা।চানাক্কেলে শহরের মাঝখানে বা সিটি সেন্টারে রয়েছে ট্রয়ের সেই বিখ্যাত ঘোড়ার একটি রেপ্লিকা।

গ্রিস-ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়ে ব্র্যাড পিট অভিনীত চলচ্চিত্র ট্রয়-এ ব্যবহারের জন্য এই ঘোড়াটি নির্মিত হয়েছিল। সাড়ে ১২ মিটার উঁচু, প্রায় ১২ টন ওজনের স্টিলের তৈরি এই বিশাল ঘোড়া পরে তুরস্ক সরকারকে দিয়ে দেয় ওয়ার্নার ব্রাদার্স। আসল ট্রয় নগরে ঢোকার আগে পর্যটকেরা আগে এই ঘোড়ার সঙ্গে ছবি তুলে নেন। ঘোড়াটার পাশেই প্রাচীন ট্রয়ের একটি সম্ভাব্য নকশা, কীভাবে এই নগরী বহিঃশত্রুদের হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষা করত, এই নকশা দেখলে কিছুটা বোঝা যায়। এমনই দুর্ভেদ্য নগরী ছিল ট্রয় যে গ্রিকরা ৯ বছর চেষ্টা করেও নগরীতে প্রবেশ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এই বিশাল ঘোড়াটিকে দেবী অ্যাথেনার আশীর্বাদ হিসেবে উপঢৌকন পাঠানো হয় ট্রয়কে, তার আগে শত শত গ্রিক জাহাজ ইজিয়ান সাগর ছেড়ে চলে যায়, যেন যুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধ জেতার আনন্দে ঘোড়াটাকে ভেতরে নিয়ে যায় ট্রয়বাসী। তারপর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ঘোড়ার পেটথেকে একে একে বেরিয়ে আসে গ্রিকরা, নগরদ্বার খুলে দেয়, যা দিয়ে প্রবেশ করে ফিরে আসা জাহাজের সব সশস্ত্র সৈন্য। আর নৃশংসভাবে তারা হত্যা করে ট্রয়ের রাজা-রানিসহ সবাইকে, আগুনে পুড়িয়ে দেয় এই অনিন্দ্যসুন্দর নগরীকে। ঘোড়ার মূর্তি থেকে আধঘণ্টা দক্ষিণে গেলেই সত্যিকারের ট্রয় নগরী।

প্রত্নতত্ত্ববিদ হেনরিখ শেইলম্যান খননকাজের সময় বুঝতে পেরেছিলেন যে এখানে কেবল একটি নয়,আছে প্রায় ৯টি ট্রয়। মানে এই নগরী বহুবার আক্রান্ত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে, কখনো শত্রুদের দ্বারা, কখনো ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, তারপর আবার পুনর্নির্মিত হয়েছে। ট্রয়ের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে এ ধারণার প্রমাণ মেলে। একেবারে ওপরে বা বাইরের দিকে যে পাথরের নির্মিত দেয়াল বা বাড়িঘরের অবশিষ্ট দেখা যাবে,তা আসলে নবম ট্রয়ের। এটি রোমানদের তৈরি। কারণ, রোমানদের ঐতিহ্যবাহী আগোরা, থিয়েটার এবং পাবলিক বিল্ডিংয়ের অবশিষ্ট দেখা যাবে এখানে। এই অংশটুকু, ইতিহাসবিদদের ধারণা, ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তৈরি।তবে যতই ভেতর দিকে যাবেন, স্তরের পর স্তর আবিষ্কৃত হতে থাকবে। এ যেন বৃত্তের বাইরে আরেকটা বৃত্ত, তার বাইরে আরেকটা বৃত্ত। একেবারে ভেতরের স্তরটি হলো প্রাচীন ট্রয়। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় যে এখানকার লাইম স্টোনের তৈরি দেয়াল এবং চারকোনা ঘরের ধ্বংসস্তূপগুলো খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছরের পুরোনো।

মানে ব্রোঞ্জ সভ্যতার শেষ দিককার কথা। কথিত আছে যে গালপিনার ও কুমতেপে এলাকার কিছু মানুষ এখানে এসে প্রথম বসত গড়ে। প্রথম ট্রয় দুর্ঘটনাবশত আগুনে পুড়ে গেলে এখানকার অধিবাসীরা আরও আধুনিক ও আরও বৃহদাকারে তাদের নগরী গড়ে তোলে, যাকে বলা হয় দ্বিতীয় ট্রয়। অচিরেই এটি হয়ে ওঠে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনস্থল। আনাতোলিয়া ও মেডিটেরিনিয়ান সভ্যতার ঠিক সংযোগস্থলে অবস্থিত এই নগরে খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে যে বিশালাকার পাথরের দেয়াল, সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের বিরাট চত্বর, ম্যাজারোন আকৃতির ঘরবাড়ি, বিরাট প্রতিরক্ষা দরজা বা গেটের অবশিষ্টের দেখা মেলে তা সত্যি আশ্চর্য করে। ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া নিদর্শন প্রমাণ করে, সেই সময়ও ট্রোজানরা পটারির কাজ করত। পটারিশিল্পে ব্যবহার করার জন্য অ্যাম্বার রং আসত বাল্টিক এলাকা থেকে, ভারত থেকে আসত লাল খনিজ কার্নেলিয়ন আর আফগানিস্তান থেকে আসত ল্যাপিস। সুপ্রাচীন এই জাতি যে ধনী, শৌখিন ও সৌন্দর্যপ্রিয় ছিল, তা এখানকার নিদর্শনগুলো থেকে বোঝা যায়।

হেনরিখ প্রথমে ভেবেছিলেন যে দ্বিতীয় ট্রয়ই হোমার-বর্ণিত ট্রয়। কিন্তু পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। কিছু নিদর্শন প্রমাণ করে যে এটি মাইসিনিয়ান গ্রিকদের আগমনেরও এক হাজার বছর পুরোনো সভ্যতা। কাজেই এটাই সেই ট্রয়, যাকে গ্রিকরা আক্রমণ করেছিল, এই অনুমান বাতিল হয়ে যায়। আসলে গ্রিক ও ট্রোজানদের মধ্যে যুদ্ধটা হয়েছিল ষষ্ঠ ও সপ্তম ট্রয়ে। এর স্থাপত্যরীতির সঙ্গে হোমারের বর্ণনা মেলে। তা ছাড়া এর ধ্বংসস্তূপে ভয়াবহ যুদ্ধ বা আক্রমণের নিদর্শনও পাওয়া যায়। তবে অনেক ইতিহাসবিদেরই ধারণা, ট্রয়ের ঘোড়ার অংশটুকু আসলে হোমারের কল্পিত, এমন কোনো ঘটনা যুদ্ধের সময় ঘটেনি। ট্রয় আসলে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।ব্রোঞ্জ আমলের ট্রয় থেকে সর্বশেষ রোমান ট্রয় পর্যন্ত এক আশ্চর্য ঐতিহাসিক যাত্রা সমাপ্ত করার পর চার হাজার বছর পুরোনো এই সভ্যতা আমাদের আপ্লুত করে। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দৃষ্টিসীমায় দেখা যায় ইজিয়ান সাগর, যা এখন অনেক দূরে চলে গেছে, সেই স্কামান্দার নদীও গেছে শুকিয়ে। এই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের বারান্দা থেকেই বৃদ্ধ রাজা প্রায়াম ও রানি হেকুবা দেখেছিলেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় পুত্র হেক্টরের মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একিলিস। আর ট্রয়ের পতনের দিন এই প্রাসাদেই বীর ও প্রায় অমর একিলিস গোড়ালিতে তিরবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই উপত্যকা আর পাহাড় এমন কত মৃত্যু, কত ধ্বংস, কত যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আছে!

ট্রয় নগরীতেছবি: লেখকের সৌজন্যে

১৮৭০ সাল থেকে ২৪টি খনন কোম্পানি প্রায় দেড় শ বছর ধরে খননকাজ চালিয়ে যা আবিষ্কার করেছে, তা অবিশ্বাস্য এক সমৃদ্ধ জাতির ইতিহাস বহন করে। বলা হয়, ট্রয়ের ইতিহাসের আরও ৭০ শতাংশ এখনো মাটির নিচেই রয়ে গেছে। এগুলোকে বের করে আনতে হয়তো আরও দেড় শ বছর লেগে যাবে। বর্তমানে ট্রয়ের খননকাজ পরিচালনা করছেন চানাক্কেলে অনসেকিজ মার্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ রুস্তম আসলান। তাঁর দলই প্রমাণ করে যে ট্রয় আসলে হোমারের বর্ণিত ট্রয়ের চেয়েও প্রাচীন, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগে এই নগরের পত্তন হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এই জায়গাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে ইউনেসকো।

ট্রয় দেখা শেষ করে খানিক দূরে দেবী অ্যাথেনার মন্দির দেখতে গেলাম। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কয়েকটি সুউচ্চ পিলার এখনো অবশিষ্ট আছে। জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা ট্রোজান ও গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী ছিলেন। কিন্তু সৌন্দর্য বিবেচনায় প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির কাছে পরাজিত হওয়ার কারণে ট্রয়বাসীকে ছেড়ে গ্রিকদের পক্ষ নেন অ্যাথেনা। স্বর্গীয় আপেলের বিনিময়ে প্যারিসকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জ্ঞান ও বিদ্যায় ভূষিত করবেন বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন অ্যাথেনা। দেবী হেরা বলেছিলেন তিনি তাঁকে দেবেন শক্তি ও ক্ষমতা। কিন্তু আফ্রোদিতি বলেছেন তিনি প্যারিসকে দেবেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুন্দরী নারীর প্রেম। প্যারিস সবকিছুর চেয়ে ভালোবাসা ও প্রেমকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ভুল করেছিলেন কি? যে ভুলের মাশুল তাঁর স্বজাতিকে দিতে হয়েছিল নৃশংস বিলুপ্তির মাধ্যমে? কে জানে! বোধ করি, দেবতা আর মানুষে এটাই বড় পার্থক্য। মানুষ ভালোবাসার জন্য সব ঝুঁকি নিতে পারে। দেবতারা পারে না।