বালু-পাথর খেকো সিন্ডিকেটের জাফলংয়ের জুমপাড়

- আপডেট সময় : ০৩:০৩:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫ ২৭ বার পড়া হয়েছে
স্টাফ রিপোর্টার :
জাফলংয়ের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত ‘জাফলং জুমপাড়’, স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘বরুনের জুং’ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাঁধের দুই পাশে শ্যালো মেশিন ও ফেলোডার (বালু তোলার পাইপ মেশিন) দিয়ে দিন-রাত অবৈধভাবে চলছে বালু ও পাথর উত্তোলন।
স্থানীয়রা জানান, এসব কার্যক্রমের পেছনে রয়েছে কিছু রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল, যারা প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, এখনই শক্ত পদক্ষেপ না নিলে জাফলংয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিবেশবাদীদের দাবি, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্রুত হস্তক্ষেপ ছাড়া জাফলংয়ের অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, প্রতিদিন শত শত ট্রাক চলে যাচ্ছে বালু ও পাথর নিয়ে। নদী আর বাঁধের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
জাফলং শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের বালিঘাট মন্দিরের জুমপাড় নামক স্থানে রাতের আঁধারে ফেলোডার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর। জুমপাড় কেটে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে শ্রী শ্রী বালিবাড়ি মন্দিরসহ অসংখ্য ফসলি জমি, পান-সুপারীর বাগান, চা-বাগান ও বসতবাড়ি
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকেই জাফলংয়ের পাথর কোয়ারীসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটে। শুধু জাফলং পাথর কোয়ারী থেকেই প্রায় শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়। পাথর লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বাদী হয়ে পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার অনেক মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে পাথর লুটপাট মামলার আসামিরা এখনও রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় যারা জাফলংয়ে বালু-পাথর লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বড় অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের পূনর্বাসনের জন্য বিএনপির প্রভাবশালী কিছু নেতা আড়ালে থেকে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জাফলং সেতু সংলগ্ন পাথর কোয়ারী এলাকায় অবৈধভাবে দানবযন্ত্র ফেলোডার মেশিন দিয়ে মাটি কেটে পাথর উত্তোলনের মচ্ছব চলছে। অবৈধভাবে ফেলোডার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে জুম পাড় এলাকায় শ্রী শ্রী বালিবাড়ি মন্দির, বল্লাঘাটের পুরাতন পর্যটন স্পট, বল্লাপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, শত হেক্টর ফসলি জমি, চা-বাগান, জাফলং সেতু, জাফলং বাজার, নয়াবস্তী, কান্দুবস্তী গ্রামের বসতবাড়ি ও খাসিয়া সম্প্রদায়ের পান-সুপারীর বাগানসহ আশপাশের এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এলাকার লোকজনের দাবি, পাথরখেকোরা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব করছে। তা না হলে তারা এত দুঃসাহস দেখাত না। প্রশাসনের দায়সারা মনোভাবের ফলে বালু-পাথরখেকোরা দিন দিন আস্কারা পাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সিন্ডিকেট। ফলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক সাথে মিলেমিশে বীরদর্পে ফেলোডার মেশিন দিয়ে মাটি কেটে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কাজ চলমান রেখেছে। স্থানীয় প্রশাসন লোক দেখানো টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান পরিচালনাকারী দল ঘটনাস্থল পৌঁছানোর আগেই আগাম খবর চলে যায় পাথরখেকো চক্রের কাছে। যে কারণে বল্লাঘাট জুম পাড় এলাকায় মন্দিরের মাটি কেটে অবৈধ পাথর উত্তোলন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলং। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ ঘেরা প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ের প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসু হাজারও পর্যটক। কিন্তু কালের বিবর্তনে জাফলং হারাচ্ছে তার নিজস্ব রূপ-লাবণ্য। পাথরখেকো চক্রের কাছে আজ পরাস্ত প্রকৃতিকন্যা। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে না কোনো আইনগত ব্যবস্থা। পরিবেশ অধিদপ্তরের অবহেলা ও পুলিশের গাফিলতির কারণে পাথর উত্তোলনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে চা-বাগান, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সাধারণ মানুষ হারাচ্ছে ফসলি জমি ও আবাসস্থল। এসব এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন ও অপসারণ করতে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি নেয়ার বিধান থাকলেও এসব নিয়মের তোয়াক্কা করে না কেউ।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার মোহাম্মদ তোফায়েল আহমদ জানান, অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে পুলিশের টহল অব্যাহত রয়েছে। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে কথা বলে টাস্কফোর্সের একটি অভিযান পরিচালনা করার ব্যবস্থা করছি। এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার পুলিশ জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলাম বলেন, জাফলং ইসিএ এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের দায়ে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। এছাড়া নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী বলেন, জাফলং ইসিএ এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবু পাথরখেকোদের থামানো সম্ভব হচ্ছে না। শিগগির টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বড় ধরনের একটি অভিযান পরিচালনা করা হবে।