ঢাকা ০৮:১০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ট্রাষ্টের মাসবপ্যাপী সেহরি বিতরণ চলমান শাকিবের যে সিনেমায় ‘বুবলী’ হয়েছিলেন অপু বিশ্বাস গাজার মুসলমানদের সমর্থনে বলিউড অভিনেত্রীর পোস্ট আরেকটি এফ-৩৫ ধ্বংস, ইসরাইলের জন্য অন্ধকার পূর্বাভাস ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা স্থাপনায় ইরানের হামলা বিমান দুর্ঘটনায় ভারতীয় ক্রিকেটারের মৃত্যু গল টেস্টের প্রথম দিনে দুই সেঞ্চুরি, ভালো পজিশনে বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের সঙ্গে ডব্লিউজিইআইডি ভাইস চেয়ারপারসনের সৌজন্য সাক্ষাৎ জরিপের ফল-পথে বেড়ে উঠা শিশুদের ৫৮ শতাংশেরই নেই জন্মসনদ চুনারুঘাট সীমান্তে বিজিবির হাতে ভারতীয় নাগরিক আটক কুলাউড়ায় ৫০০ চক্ষু রোগীকে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দিল ‘এনএসএস’

সিলেটে যেভাবে ইসলাম প্রচার করেছেন হজরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:৪৮:৪১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫ ২১ বার পড়া হয়েছে

ভিউ নিউজ ৭১ ডেস্ক :

হজরত শায়খ জালালুদ্দীন মুজাররদ ইয়েমনী (রহ.)। যিনি হযরত শাহ জালাল (রহ.) নামেই পরিচিত। তিনি সমগ্র বাংলা, ত্রিপুরা ও আসামে দ্বীনের সরল পথের দিশাদানে—অর্থাৎ ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায়— ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী ও অগ্রগণ্য ছিলেন ।

বাংলার প্রাচীন মুদ্রা, শিলালিপি, সমসাময়িক ও পরবর্তী রচনাবলীতে তার ঐতিহাসিক অবদান ও উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি কুরাইশ বংশীয় ইয়েমেনের এক প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম কুরাইশি (রহ.)।

শাসনক্ষমতার আসনে বসা ছাড়াই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষকে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে আহ্বান— সবকিছুর বাস্তব দৃষ্টান্ত ছিলেন হজরত শাহ জালাল (রহ.)

রাজশক্তির তরবারি যেখানে সফল হয়নি, সেখানে আল্লাহপ্রদত্ত আধ্যাত্মিক শক্তি ও নববী আদর্শের সৌন্দর্য দিয়ে তিনি হৃদয় জয় করেছেন, সমাজ বদলেছেন।

৭০৩ হিজরির ২৬ শে শাওয়াল ৩৬০ জন আউলিয়ার সহযাত্রায় তিনি গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট বিজয় করেন এবং সেখানে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করেন।

হজরত শাহ জালাল (রহ.) মক্কা শরীফে তার মামা ও মুরশিদ হজরত আহমদ কবীর সোহরাওয়ার্দি (রহ.) প্রদত্ত মাটির সাথে সিলেটের মাটির মিল পেয়েছিলেন। তাই মুরশিদের নির্দেশে সিলেটেই স্থায়ীভাবে অবস্থান করেন এবং ইন্তেকাল পর্যন্ত সেখানে দ্বীনের খেদমত করেন।

তার জ্ঞানে-গুণে গড়ে ওঠা অনুসারীরা ছড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ, ভারত ও বার্মার বিভিন্ন স্থানে। তিনি কুসংস্কার, শ্রেণীভেদ ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে প্রতিষ্ঠা করেন এক শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও সাম্যের সমাজ। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়।

বিশ্বখ্যাত মরক্কোর পরিব্রাজক ও ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা খ্যাতি শুনে বহু কষ্ট স্বীকার করে সিলেটে এসে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন—

‘আমি যখন এই মহাপুরুষের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে আসছিলাম, তখন তার চারজন সঙ্গীর সাথে দেখা হয়। তারা জানালেন, ‘শায়খ সাহেব ফকিরদের বলে দিয়েছেন, এক মরক্কোবাসী ভ্রমণকারী আসছেন, তাকে আগবাড়িয়ে নিয়ে এসো।’ শায়খের এ দিব্যজ্ঞান আমাকে অভিভূত করে।’

ইবনে বতুতা আরও লিখেছেন যে, বিদায়কালে শাহ জালাল (রহ.) তাকে একটি উলের তৈরি আলখেল্লা ও নিজের মাথার টুপি উপহার দেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেন— এই আলখেল্লা এক কাফের রাজার হাতে যাবে, সেখান থেকে তা পৌছাবে চীনের খানবালিতে তার পীরভ্রাতা বাহাউদ্দীন সাগরজির (রহ.) কাছে। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ঘটনাগুলো পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়।

বাহাউদ্দীন সাগরজি (রহ.) ইবনে বতুতাকে বলেন, শায়খ জালালুদ্দীনের মর্যাদা এ জগতের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ১৫০ বছর বাচার পর ইন্তেকাল করেছেন।

হজরত শাহ জালাল (রহ.) মৃত্যুর আগের দিন তার শিষ্যদের বলেন ‘তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো, তাকে ভয় করো। কাল আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব।’

পরদিন, ১৯ শে জিলকদ, জোহরের নামাজের শেষ সিজদায় তিনি ইন্তেকাল করেন। অলৌকিকভাবে তার হুজরার পাশে এক কবর খোদিত পাওয়া যায় এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়, যেখানে পূর্ব থেকেই সুগন্ধময় কাফনের ব্যবস্থাও ছিল।

আল্লাহ তায়ালা বলেন সফল সেই, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। (সূরা শামস)।

বাংলার এই ভূমিতে আত্মশুদ্ধির আলো ছড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে হজরত শাহ জালাল (রহ.)-ই সর্বাধিক সফল ও প্রভাবশালী ছিলেন।

পাণ্ডুয়ার এক প্রাচীন শিলালিপিতে তাকে বলা হয়েছে:

“জালালুদ্দীন জালালুল্লাহ্ জালালে আরিফান বুয়াদ” অর্থাৎ, “জালালুদ্দীন ছিলেন আল্লাহর দীপ্তি ও আরেফগণের গৌরব।”

শতাধিক বছর আগে বিশিষ্ট সুফি আলেম শায়খ আবদুস সোবহান আল-ক্বাদেরী (রহ.) এক কাসিদায় লেখেন:

“আন্তা সুলতানুল বাংলা জাহিরাওঁ ওয়া বাতেনান/ আমিরু মুলকা ক্বালবি লা তকলনি” অর্থাৎ, “তুমি বাংলার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বাদশাহ; ক্বালবের রাজত্বেও তুমি অধিপতি।”

তার সংগী হজরত হাজী ইউসুফ (রহ.)-এর বংশধরদের তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর ১৯ ও ২০ শে জিলকদ সিলেট দরগাহ শরীফে হজরত শাহ জালাল (রহ.)-এর ওরস মহাসমারোহে উদযাপিত হয়—যেখানে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীভেদ ভুলে মানুষ একত্রিত হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

সিলেটে যেভাবে ইসলাম প্রচার করেছেন হজরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)

আপডেট সময় : ০২:৪৮:৪১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

ভিউ নিউজ ৭১ ডেস্ক :

হজরত শায়খ জালালুদ্দীন মুজাররদ ইয়েমনী (রহ.)। যিনি হযরত শাহ জালাল (রহ.) নামেই পরিচিত। তিনি সমগ্র বাংলা, ত্রিপুরা ও আসামে দ্বীনের সরল পথের দিশাদানে—অর্থাৎ ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায়— ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী ও অগ্রগণ্য ছিলেন ।

বাংলার প্রাচীন মুদ্রা, শিলালিপি, সমসাময়িক ও পরবর্তী রচনাবলীতে তার ঐতিহাসিক অবদান ও উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি কুরাইশ বংশীয় ইয়েমেনের এক প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম কুরাইশি (রহ.)।

শাসনক্ষমতার আসনে বসা ছাড়াই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষকে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে আহ্বান— সবকিছুর বাস্তব দৃষ্টান্ত ছিলেন হজরত শাহ জালাল (রহ.)

রাজশক্তির তরবারি যেখানে সফল হয়নি, সেখানে আল্লাহপ্রদত্ত আধ্যাত্মিক শক্তি ও নববী আদর্শের সৌন্দর্য দিয়ে তিনি হৃদয় জয় করেছেন, সমাজ বদলেছেন।

৭০৩ হিজরির ২৬ শে শাওয়াল ৩৬০ জন আউলিয়ার সহযাত্রায় তিনি গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট বিজয় করেন এবং সেখানে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করেন।

হজরত শাহ জালাল (রহ.) মক্কা শরীফে তার মামা ও মুরশিদ হজরত আহমদ কবীর সোহরাওয়ার্দি (রহ.) প্রদত্ত মাটির সাথে সিলেটের মাটির মিল পেয়েছিলেন। তাই মুরশিদের নির্দেশে সিলেটেই স্থায়ীভাবে অবস্থান করেন এবং ইন্তেকাল পর্যন্ত সেখানে দ্বীনের খেদমত করেন।

তার জ্ঞানে-গুণে গড়ে ওঠা অনুসারীরা ছড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ, ভারত ও বার্মার বিভিন্ন স্থানে। তিনি কুসংস্কার, শ্রেণীভেদ ও সামাজিক বৈষম্য দূর করে প্রতিষ্ঠা করেন এক শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও সাম্যের সমাজ। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়।

বিশ্বখ্যাত মরক্কোর পরিব্রাজক ও ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা খ্যাতি শুনে বহু কষ্ট স্বীকার করে সিলেটে এসে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন—

‘আমি যখন এই মহাপুরুষের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে আসছিলাম, তখন তার চারজন সঙ্গীর সাথে দেখা হয়। তারা জানালেন, ‘শায়খ সাহেব ফকিরদের বলে দিয়েছেন, এক মরক্কোবাসী ভ্রমণকারী আসছেন, তাকে আগবাড়িয়ে নিয়ে এসো।’ শায়খের এ দিব্যজ্ঞান আমাকে অভিভূত করে।’

ইবনে বতুতা আরও লিখেছেন যে, বিদায়কালে শাহ জালাল (রহ.) তাকে একটি উলের তৈরি আলখেল্লা ও নিজের মাথার টুপি উপহার দেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেন— এই আলখেল্লা এক কাফের রাজার হাতে যাবে, সেখান থেকে তা পৌছাবে চীনের খানবালিতে তার পীরভ্রাতা বাহাউদ্দীন সাগরজির (রহ.) কাছে। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ঘটনাগুলো পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়।

বাহাউদ্দীন সাগরজি (রহ.) ইবনে বতুতাকে বলেন, শায়খ জালালুদ্দীনের মর্যাদা এ জগতের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ১৫০ বছর বাচার পর ইন্তেকাল করেছেন।

হজরত শাহ জালাল (রহ.) মৃত্যুর আগের দিন তার শিষ্যদের বলেন ‘তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো, তাকে ভয় করো। কাল আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব।’

পরদিন, ১৯ শে জিলকদ, জোহরের নামাজের শেষ সিজদায় তিনি ইন্তেকাল করেন। অলৌকিকভাবে তার হুজরার পাশে এক কবর খোদিত পাওয়া যায় এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়, যেখানে পূর্ব থেকেই সুগন্ধময় কাফনের ব্যবস্থাও ছিল।

আল্লাহ তায়ালা বলেন সফল সেই, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। (সূরা শামস)।

বাংলার এই ভূমিতে আত্মশুদ্ধির আলো ছড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে হজরত শাহ জালাল (রহ.)-ই সর্বাধিক সফল ও প্রভাবশালী ছিলেন।

পাণ্ডুয়ার এক প্রাচীন শিলালিপিতে তাকে বলা হয়েছে:

“জালালুদ্দীন জালালুল্লাহ্ জালালে আরিফান বুয়াদ” অর্থাৎ, “জালালুদ্দীন ছিলেন আল্লাহর দীপ্তি ও আরেফগণের গৌরব।”

শতাধিক বছর আগে বিশিষ্ট সুফি আলেম শায়খ আবদুস সোবহান আল-ক্বাদেরী (রহ.) এক কাসিদায় লেখেন:

“আন্তা সুলতানুল বাংলা জাহিরাওঁ ওয়া বাতেনান/ আমিরু মুলকা ক্বালবি লা তকলনি” অর্থাৎ, “তুমি বাংলার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বাদশাহ; ক্বালবের রাজত্বেও তুমি অধিপতি।”

তার সংগী হজরত হাজী ইউসুফ (রহ.)-এর বংশধরদের তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর ১৯ ও ২০ শে জিলকদ সিলেট দরগাহ শরীফে হজরত শাহ জালাল (রহ.)-এর ওরস মহাসমারোহে উদযাপিত হয়—যেখানে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীভেদ ভুলে মানুষ একত্রিত হয়।