ঢাকা ০৩:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ট্রাষ্টের মাসবপ্যাপী সেহরি বিতরণ চলমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন হচ্ছে- অস্ত্রসহ আটক বিএনপি নেতার ছেলে এডভোকেট গাফফার ও বাবলুর সুস্থতা কামনায় সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের দোয়া ভোর রাতে সিলেটে গোয়াইনঘাটে যুবক খু ন বিশ্বনাথে শিশু নির্যাতন, ইউপি চেয়ারম্যান’সহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মা ম লা ৫০কোটি টাকার ভারতীয় চিনির চালান আটক বিশ্বনাথে ঘুষ নেওয়ার অভিযােগে এস আই আলীম উদ্দিন ক্লো জ নারকেল তেলের সঙ্গে যা মেশালে কমবে চু ল পড়া প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক লতিফেহকে গ্রেফতার করল ইসরাইল অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্স ও জেসিআই ঢাকা ইউনাইটেডের সমঝোতা চুক্তি

এক বছরে ২৩০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের মাইলফলক হিসেবে সভাপতি করা হয়েছে ফারজানাকে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৪:১৬:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৪ ৬৮ বার পড়া হয়েছে

ভিউ নিউজ ৭১ ডেস্ক :

হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ। শিক্ষা-দীক্ষায় এখনো অনেক পিছিয়ে এখানকার মানুষ। তাই হয়তো অনেকের মাঝে তৈরি হয়নি স্বেচ্ছায় রক্তদানের প্রবণতা। তবে জীবন বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন তো আর থেমে নেই। বিভিন্ন সময় রোগীকে বাঁচাতে রক্তের জন্য দ্বারে দ্বারে ছুতে বেড়াতে হয় স্বজনদের। বিপদগ্রস্ত সেইসব রোগী ও তাদের স্বজনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন হাওরপাড়ের শিক্ষার্থী ফারজানা বেগম।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪র্থ বর্ষে পড়ালেখা করছেন তিনি। সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এই জেলায় শুধু ২০২৩ সালেই স্বেচ্ছাশ্রমে ২৩০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছেন ফারজানা। ২০২২ সালে যার পরিমাণ ছিল আরও বেশি প্রায় ২৪৩ ব্যাগ।ফারজানা সুনামগঞ্জের ছাতকের সিংচাপইড় ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামের মৃত মশাহিদ আলীর মেয়ে। ৫ ভাই ৩ বোনের মধ্যে ৬ষ্ঠ সন্তান ফারজানা। কুমার কান্দি ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা থেকে এসএসসি পাস করে তার কলেজ জীবন শুরু হয় সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে।

পড়ালেখার পাশাপাশি জরুরি মুহূর্তে অন্যের জন্য রক্তের জোগাড় করাই যেন তার নেশা। বিভিন্ন দুর্ঘটনা বা শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব রক্তের যোগান দিয়ে থাকেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের এই শিক্ষার্থী। শুধু রক্ত মিলিয়ে দেওয়াই নয় ফারজানা নিজেও একজন নিয়মিত রক্তদাতা। তার মিলিয়ে দেওয়া এসব রক্তে বেঁচেছে অনেকের প্রাণ।

বিশ্বম্ভপুরের মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে আব্দুল হালিম (২২) থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী। ৫ বছর বয়স থেকে প্রত্যেক মাসে তার এক ব্যাগ এবি+ রক্তের প্রয়োজন। বিগত দুই বছর ধরে তার রক্তের যোগান দিচ্ছেন ফারজানা।হালিম বলেন, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বড় ভাই কৃষিকাজ করে সংসার চালান। ছোটবেলা থেকে মানুষের রক্ত নিয়ে বেঁচে আছি। গত দু বছর ধরে ফারজানা আপু আমাকে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়। শুধু রক্তের ব্যবস্থা নয় রক্ত নেওয়ার ব্যাগও ফারজানা আপু নিজের টাকা দিয়ে কিনে দেয়।

একই উপজেলার সাতগাঁও গ্রামের জুয়েল বলেন, আমার ছেলে সিয়াম ৫ বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়ে ৪ মাস আগে মারা গেছে। মারা যাওয়ার আগে তার নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হতো। গত দু বছর ধরে তাকে নিজের শরীরের রক্তের পাশাপাশি অন্যদের কাছ থেকে রক্ত এনে দিয়েছে ফারজানা। ফারজানার মতো মানুষের জন্য বেঁচে ছিল আমার ছেলে। আমার ছেলের জন্য অনেক কষ্ট করেছে ফারজানা। মৃত্যুর পরে ফারজানাকে শেষবারের মতো আমার ছেলের সঙ্গে দেখা করিয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফারজানাকে ফোনে না পাওয়ায় আর সেটা হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত ফারজানার সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। প্রায়ই নিজ থেকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয়।

নারী-পুরুষের বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখার ইচ্ছাশক্তি থেকে এমন মানবিক কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান ফারজানা। রক্তদান আন্দোলনের চলার পথে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েও মানুষের জীবনের কথা চিন্তা করে সেসব বাঁধা অতিক্রম করেছেন তিনি। হাওরপাড়ের একজন সাধারণ মেয়ে হয়ে মানুষের জন্য তার এমন মানবিক কাজ উদাহরণ হিসেবে দেখছেন কলেজের অন্যান্যরা।

ফারজানা দেশের বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ইউনিটের সদস্য। গত ২০২২ সালে সুনামগঞ্জে ৮০০ ব্যাগ রক্তের চাহিদার প্রেক্ষিতে ৬৯৪ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছে ফারজানার সংগঠন ‘বাঁধন’। যার মধ্যে নতুন রক্তদাতা ১২৪ জন এবং ফারজানার সংগৃহীত ২৩০ ব্যাগ রক্ত।বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে এক বছরে ফারজানার ২৩০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের মাইলফলক হিসেবে নতুন কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফারজানাকে।

ফারজানা বলেন, পড়ালেখা করায় প্রতিনিয়ত সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না তবে যখনই সময় পাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করি রক্তদাতাদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অথবা ফোন কলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার। সবার জীবনেই ব্যস্ততা থাকে। সব কিছু ম্যানেজ করে যতটুকু সম্ভব রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পড়ালেখার পাশাপাশি অবসর সময়কে মুমূর্ষু-অসহায় রোগীদের কাজে লাগাচ্ছি। বাকি কাজটা সহজ করে দিয়েছে আমার প্রাণপ্রিয় রক্তদাতা ভাই-বোনেরা। আমার এ কাজে পরিবারের সহযোগিতা ছিল বলে মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারছি। রক্ত যোগানের কাজ করার কারণে পড়াশোনার তেমন একটা ক্ষতি হয়নি বন্ধু-বান্ধব সবার সহযোগিতা থাকায়। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি এই কাজকে মন থেকে ভালোবেসে করে থাকি।

রক্তদানের সঙ্গে জড়িত হওয়া প্রসঙ্গে ফারজানা বলেন, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাঁধনের ব্যানার দেখে মনে হলো আমিও এই কাজ করব। পরে যখন কলেজে আসা-যাওয়া শুরু হলো তখন বাঁধন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। একদিন দেখতে পেলাম বাঁধন কর্মীরা সংগ্রহ করছে তখন আমি এবং আমার বোন নাম দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নেই। এরপর থেকেই বাঁধনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। আমি প্রত্যেক রক্তযোদ্ধার আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ যেন নিজের রক্তের গ্রুপ জানতে পারে এবং স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য এগিয়ে আসে আমি এই স্বপ্ন দেখি। চলার পথে অনেক সমস্যা হয়েছে শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে। মানুষের জীবনের কথা চিন্তা করে সেই সব উপেক্ষা করে গিয়েছি। মেয়েরাও চাইলে সম্মানের সঙ্গে অনেক কিছু করতে পারে এটা দেখিয়ে দিতে চাই। ধৈর্য, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো কাজ মেয়েরাও করতে পারে এটাই সবাইকে জানান দিতে চাই।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল হাসান বলেন, জরুরি মুহূর্তে এক ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করতে পাগলপ্রায় অবস্থা হয়। এক ব্যাগ রক্তের জন্য অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। সেখানে ২৩০ ব্যাগ রক্ত মেলানো এতো সহজ কাজ নয়। অন্তত সহস্রাধিক মানুষের সাথে কথা বলে তাদের বুঝিয়ে আনতে হবে। এটা অনেক ধৈর্য ও পরিশ্রমের কাজ। এমন মানুষ সবার থেকে অনন্য ও আলাদা।

অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার আলম বলেন, দানের বিষয়ে মানুষকে ম্যানেজ করা সবচেয়ে কঠিন একটা কাজ। রক্ত দেওয়ার বিষয়ে মানুষের সাধারণত একটা ভীতি কাজ। তারা ভাবে যে, কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম যখন শুনলাম আমার একটি মেয়ে এমন অবাক করা কাজ করেছে। মেয়ে হয়ে এতগুলো মানুষের সঙ্গে কানেক্টিভিটি করেছে এবং আস্থার জায়গা গড়ে তুলেছে। মানুষ তাকে ভরসা করে রক্ত দিতে এগিয়ে এসেছে। বর্তমান ফেসবুক জেনারেশন বা টিকটক জেনারেশন যাদের নিয়ে নেগেটিভ কথাবার্তা হয় সে সময়ে এমন একটা ভালো কাজে জড়িয়ে থাকা এটা অনন্য একটা নজির। আমাদের অনেক রিমোট এরিয়া আছে যেখানে গিয়ে মাস্টার্স পাসসহ অনেক শিক্ষিত মানুষ পাই। কিন্তু যেটা পাইনা সেটা হলো মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ। এমন ফারজানা ঘরে ঘরে জন্ম হলে মানবিক বিশ্ব গড়া যাবে। এই স্বাধীন দেশের সংগ্রাম করা মানুষ গুলো আগামীর বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখে গেছে ফারজানারা এগিয়ে এলে তাদের নেতৃত্বে সেই সোনার বাংলা
নির্মাণ হবে।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আমার কলেজের মেয়ে ফারজানা যে কাজ করে যাচ্ছে আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাই। আমি চাই এই ফারজানা শুধু বাঁধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকুক। আমার কলেজের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে যাক বিস্তৃত হউক। তার জন্যে সকল ধরনের সহযোগিতা আমরা করে যাব।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

এক বছরে ২৩০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের মাইলফলক হিসেবে সভাপতি করা হয়েছে ফারজানাকে

আপডেট সময় : ০৪:১৬:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৪

ভিউ নিউজ ৭১ ডেস্ক :

হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ। শিক্ষা-দীক্ষায় এখনো অনেক পিছিয়ে এখানকার মানুষ। তাই হয়তো অনেকের মাঝে তৈরি হয়নি স্বেচ্ছায় রক্তদানের প্রবণতা। তবে জীবন বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন তো আর থেমে নেই। বিভিন্ন সময় রোগীকে বাঁচাতে রক্তের জন্য দ্বারে দ্বারে ছুতে বেড়াতে হয় স্বজনদের। বিপদগ্রস্ত সেইসব রোগী ও তাদের স্বজনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন হাওরপাড়ের শিক্ষার্থী ফারজানা বেগম।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪র্থ বর্ষে পড়ালেখা করছেন তিনি। সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এই জেলায় শুধু ২০২৩ সালেই স্বেচ্ছাশ্রমে ২৩০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছেন ফারজানা। ২০২২ সালে যার পরিমাণ ছিল আরও বেশি প্রায় ২৪৩ ব্যাগ।ফারজানা সুনামগঞ্জের ছাতকের সিংচাপইড় ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামের মৃত মশাহিদ আলীর মেয়ে। ৫ ভাই ৩ বোনের মধ্যে ৬ষ্ঠ সন্তান ফারজানা। কুমার কান্দি ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা থেকে এসএসসি পাস করে তার কলেজ জীবন শুরু হয় সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে।

পড়ালেখার পাশাপাশি জরুরি মুহূর্তে অন্যের জন্য রক্তের জোগাড় করাই যেন তার নেশা। বিভিন্ন দুর্ঘটনা বা শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব রক্তের যোগান দিয়ে থাকেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের এই শিক্ষার্থী। শুধু রক্ত মিলিয়ে দেওয়াই নয় ফারজানা নিজেও একজন নিয়মিত রক্তদাতা। তার মিলিয়ে দেওয়া এসব রক্তে বেঁচেছে অনেকের প্রাণ।

বিশ্বম্ভপুরের মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে আব্দুল হালিম (২২) থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী। ৫ বছর বয়স থেকে প্রত্যেক মাসে তার এক ব্যাগ এবি+ রক্তের প্রয়োজন। বিগত দুই বছর ধরে তার রক্তের যোগান দিচ্ছেন ফারজানা।হালিম বলেন, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বড় ভাই কৃষিকাজ করে সংসার চালান। ছোটবেলা থেকে মানুষের রক্ত নিয়ে বেঁচে আছি। গত দু বছর ধরে ফারজানা আপু আমাকে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়। শুধু রক্তের ব্যবস্থা নয় রক্ত নেওয়ার ব্যাগও ফারজানা আপু নিজের টাকা দিয়ে কিনে দেয়।

একই উপজেলার সাতগাঁও গ্রামের জুয়েল বলেন, আমার ছেলে সিয়াম ৫ বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়ে ৪ মাস আগে মারা গেছে। মারা যাওয়ার আগে তার নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হতো। গত দু বছর ধরে তাকে নিজের শরীরের রক্তের পাশাপাশি অন্যদের কাছ থেকে রক্ত এনে দিয়েছে ফারজানা। ফারজানার মতো মানুষের জন্য বেঁচে ছিল আমার ছেলে। আমার ছেলের জন্য অনেক কষ্ট করেছে ফারজানা। মৃত্যুর পরে ফারজানাকে শেষবারের মতো আমার ছেলের সঙ্গে দেখা করিয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফারজানাকে ফোনে না পাওয়ায় আর সেটা হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত ফারজানার সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। প্রায়ই নিজ থেকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয়।

নারী-পুরুষের বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখার ইচ্ছাশক্তি থেকে এমন মানবিক কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান ফারজানা। রক্তদান আন্দোলনের চলার পথে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েও মানুষের জীবনের কথা চিন্তা করে সেসব বাঁধা অতিক্রম করেছেন তিনি। হাওরপাড়ের একজন সাধারণ মেয়ে হয়ে মানুষের জন্য তার এমন মানবিক কাজ উদাহরণ হিসেবে দেখছেন কলেজের অন্যান্যরা।

ফারজানা দেশের বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ইউনিটের সদস্য। গত ২০২২ সালে সুনামগঞ্জে ৮০০ ব্যাগ রক্তের চাহিদার প্রেক্ষিতে ৬৯৪ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছে ফারজানার সংগঠন ‘বাঁধন’। যার মধ্যে নতুন রক্তদাতা ১২৪ জন এবং ফারজানার সংগৃহীত ২৩০ ব্যাগ রক্ত।বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে এক বছরে ফারজানার ২৩০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের মাইলফলক হিসেবে নতুন কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফারজানাকে।

ফারজানা বলেন, পড়ালেখা করায় প্রতিনিয়ত সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না তবে যখনই সময় পাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করি রক্তদাতাদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অথবা ফোন কলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার। সবার জীবনেই ব্যস্ততা থাকে। সব কিছু ম্যানেজ করে যতটুকু সম্ভব রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পড়ালেখার পাশাপাশি অবসর সময়কে মুমূর্ষু-অসহায় রোগীদের কাজে লাগাচ্ছি। বাকি কাজটা সহজ করে দিয়েছে আমার প্রাণপ্রিয় রক্তদাতা ভাই-বোনেরা। আমার এ কাজে পরিবারের সহযোগিতা ছিল বলে মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারছি। রক্ত যোগানের কাজ করার কারণে পড়াশোনার তেমন একটা ক্ষতি হয়নি বন্ধু-বান্ধব সবার সহযোগিতা থাকায়। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি এই কাজকে মন থেকে ভালোবেসে করে থাকি।

রক্তদানের সঙ্গে জড়িত হওয়া প্রসঙ্গে ফারজানা বলেন, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাঁধনের ব্যানার দেখে মনে হলো আমিও এই কাজ করব। পরে যখন কলেজে আসা-যাওয়া শুরু হলো তখন বাঁধন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। একদিন দেখতে পেলাম বাঁধন কর্মীরা সংগ্রহ করছে তখন আমি এবং আমার বোন নাম দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নেই। এরপর থেকেই বাঁধনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। আমি প্রত্যেক রক্তযোদ্ধার আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ যেন নিজের রক্তের গ্রুপ জানতে পারে এবং স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য এগিয়ে আসে আমি এই স্বপ্ন দেখি। চলার পথে অনেক সমস্যা হয়েছে শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে। মানুষের জীবনের কথা চিন্তা করে সেই সব উপেক্ষা করে গিয়েছি। মেয়েরাও চাইলে সম্মানের সঙ্গে অনেক কিছু করতে পারে এটা দেখিয়ে দিতে চাই। ধৈর্য, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো কাজ মেয়েরাও করতে পারে এটাই সবাইকে জানান দিতে চাই।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল হাসান বলেন, জরুরি মুহূর্তে এক ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করতে পাগলপ্রায় অবস্থা হয়। এক ব্যাগ রক্তের জন্য অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। সেখানে ২৩০ ব্যাগ রক্ত মেলানো এতো সহজ কাজ নয়। অন্তত সহস্রাধিক মানুষের সাথে কথা বলে তাদের বুঝিয়ে আনতে হবে। এটা অনেক ধৈর্য ও পরিশ্রমের কাজ। এমন মানুষ সবার থেকে অনন্য ও আলাদা।

অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার আলম বলেন, দানের বিষয়ে মানুষকে ম্যানেজ করা সবচেয়ে কঠিন একটা কাজ। রক্ত দেওয়ার বিষয়ে মানুষের সাধারণত একটা ভীতি কাজ। তারা ভাবে যে, কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম যখন শুনলাম আমার একটি মেয়ে এমন অবাক করা কাজ করেছে। মেয়ে হয়ে এতগুলো মানুষের সঙ্গে কানেক্টিভিটি করেছে এবং আস্থার জায়গা গড়ে তুলেছে। মানুষ তাকে ভরসা করে রক্ত দিতে এগিয়ে এসেছে। বর্তমান ফেসবুক জেনারেশন বা টিকটক জেনারেশন যাদের নিয়ে নেগেটিভ কথাবার্তা হয় সে সময়ে এমন একটা ভালো কাজে জড়িয়ে থাকা এটা অনন্য একটা নজির। আমাদের অনেক রিমোট এরিয়া আছে যেখানে গিয়ে মাস্টার্স পাসসহ অনেক শিক্ষিত মানুষ পাই। কিন্তু যেটা পাইনা সেটা হলো মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ। এমন ফারজানা ঘরে ঘরে জন্ম হলে মানবিক বিশ্ব গড়া যাবে। এই স্বাধীন দেশের সংগ্রাম করা মানুষ গুলো আগামীর বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখে গেছে ফারজানারা এগিয়ে এলে তাদের নেতৃত্বে সেই সোনার বাংলা
নির্মাণ হবে।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আমার কলেজের মেয়ে ফারজানা যে কাজ করে যাচ্ছে আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাই। আমি চাই এই ফারজানা শুধু বাঁধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকুক। আমার কলেজের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে যাক বিস্তৃত হউক। তার জন্যে সকল ধরনের সহযোগিতা আমরা করে যাব।