হাজার হাজার ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া খালিদ-খাইরুলের হদিস নেই

- আপডেট সময় : ০৪:৪৩:১৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩ ৭৮ বার পড়া হয়েছে

জন্মনিবন্ধনের সরকারি সার্ভার ছিল তাঁদের হাতের মুঠোয়।চাইলেই পাসওয়ার্ড দিয়ে দেশের যেকোনো স্থানে অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের তথ্য সংযুক্ত (এন্ট্রি) ও সংশোধন করতে পারতেন।স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) সাবেক প্রোগ্রামার মো.খালিদ ও লক্ষ্মীপুরের খাইরুল ইসলাম নামের এ দুই ব্যক্তি যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ দুজন সম্পর্কে জানতে পেরেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, চট্টগ্রাম। তাঁরা হাজার হাজার জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।২০২১ সালের জুনে চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার এবং উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে নয়টি জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির ঘটনায় মামলা হয়। মামলাগুলো করা হয় ওয়ার্ডগুলোর পক্ষ থেকে। এসব মামলা তদন্ত করছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের উপপরিদর্শক স্বপন কুমার সরকার।
সার্ভার হ্যাক করে চট্টগ্রাম,ঢাকা উত্তর,ঢাকা দক্ষিণ,কুমিল্লা,সিলেট,ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ ফরিদপুর, বাগেরহাট,নরসিংদী জেলায় কয়েক হাজারের বেশি জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন গ্রেপ্তার হ্যাকাররা।স্বপন কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন,জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেপ্তার করা আশরাফুল আলম নামের একজন জন্মনিবন্ধনের সার্ভারে ঢুকে দেশের যেকোনো স্থানের ঠিকানায় তথ্য সংযুক্ত করার কথা স্বীকার করেছেন। প্রতিটি নিবন্ধনের জন্য এক থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি।তাঁকে সার্ভারের পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন খালিদ।তাই খালিদকে দিতেন নিবন্ধনপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।আশরাফুলের জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী, লক্ষ্মীপুরের খাইরুলের মাধ্যমে খালিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, রাজশাহী, যশোরের বিভিন্ন এলাকার দালালের মাধ্যমে কাজ নিতেন তিনি।তাঁর বাড়ি যশোরের শার্শায়।তিনি টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার দুই থেকে তিন হাজার মানুষকে জন্মনিবন্ধন সনদ পাইয়ে দিয়েছেন।
এভাবে সারা দেশে খালিদ ও খাইরুলের আরও লোকজন রয়েছে।তাঁরা ঠিক কত জন্মনিবন্ধন করেছেন, তা দুজনকে না ধরা পর্যন্ত বলা যাবে না বলে জানান স্বপন কুমার সরকার।
জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতির ঘটনায় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিভাগের কেউ জড়িত থাকলে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।ইতিমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মো. রাশেদুল হাসান,রেজিস্ট্রার জেনারেল, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার বাসিন্দা খালিদ জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিভাগের প্রোগ্রামার ছিলেন।সার্ভারের পাসওয়ার্ড ছিল তাঁর কাছে।তিনি পাসওয়ার্ড টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচিত দালালদের দিতেন। ২০১৮ সালে খালিদের চুক্তিভিত্তিক চাকরি হয়।এরপরও তিনি সার্ভারটি নিজের আয়ত্তে রাখেন ও খাইরুলকে দিয়ে জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির নেটওয়ার্ক চালিয়ে যান।সূত্র আরও জানায়,খাইরুল ঢাকার কারওয়ান বাজারে একটি বিদেশি পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ছিলেন।কাজের সুবাদে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন লোকের সখ্য হয়।খালিদের সঙ্গেও পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয়।পরে হোয়াটসঅ্যাপে পেজ খুলে জন্মনিবন্ধন সনদ করে দেওয়ার প্রচারণা চালান।
সনদ জালিয়াতির ঘটনায় পুলিশি অভিযান শুরু হওয়ার পর খালিদ ও খাইরুল গা ঢাকা দেন।পরে দেশের বাইরে চলে যান।দেশে এলে তাঁদের যাতে গ্রেপ্তার করা হয়,সে জন্য পুলিশের অভিবাসন শাখায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে সম্প্রতি চিঠি পাঠানো হয়েছে।খালিদ ও খাইরুল গা ঢাকা দিলেও থেমে থাকেনি জন্মনিবন্ধন জালিয়াতি।গত ৮ থেকে ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫টি ওয়ার্ডের আইডি ব্যবহার করে সার্ভারে ঢুকে ৫৪৭টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়।সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি নগরের লালখান বাজার ওয়ার্ডে ১৩৩টি সনদ অবৈধভাবে ইস্যু হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।সনদ জালিয়াতির ঘটনায় এ পর্যন্ত হওয়া তিনটি মামলাই তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ১২ জনকে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন,সার্ভার হ্যাক করে চট্টগ্রাম,ঢাকা উত্তর,ঢাকা দক্ষিণ,কুমিল্লা,সিলেট,ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ ফরিদপুর,বাগেরহাট,নরসিংদী জেলায় কয়েক হাজারের বেশি জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন গ্রেপ্তার হ্যাকাররা।তিনি বলেন,তবে বর্তমানে হ্যাক করার সুযোগ নেই।সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীর মুঠোফোনে ওটিপি যাওয়ার কারণে হ্যাকার কিংবা পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে নিবন্ধন করার সুযোগ নেই।তবে খালিদ ও খাইরুলকে ধরতে পারলে তাঁদের চক্রে সার্ভারের দায়িত্বে থাকা কেউ জড়িত কি না,তা বেরিয়ে আসত।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি সার্ভারের পাসওয়ার্ড তৃতীয় ব্যক্তির কাছে গেল কীভাবে। আর এটি হ্যাক হয় কীভাবে।শর্ষের মধ্যে ভূত না থাকলে এটি সম্ভব নয়।সার্ভারটি সুরক্ষার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।তাঁরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না।আর স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন,খালিদ নামে তাঁদের একজন প্রোগ্রামার ছিলেন,এখন নেই।সার্ভারের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।তিনি আরও বলেন,সনদ জালিয়াতির ঘটনায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিভাগের কেউ জড়িত থাকলে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
চাকরি শেষ হওয়ার পরও সরকারি সার্ভারের পাসওয়ার্ড খালিদের কাছে কীভাবে থাকে,তা জানতে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) কাছে চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা স্বপন কুমার সরকার।এদিকে সার্ভারের পাসওয়ার্ড কেন বদলানো হয়নি,আর এটি খালিদের কাছে কীভাবে থাকে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল,জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন মো. রাশেদুল হাসান বলেন,আরও অনেক খালিদ হয়তো ছিল।এ কারণে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।এখন সার্ভারের যথেষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।