মৌলভীবাজারের কুলাউড়া দুর্গোৎসবে মেতেছে ঐতিহ্যবাহী শিববাড়ি মন্দির

- আপডেট সময় : ০১:১২:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬ বার পড়া হয়েছে
কুলাউড়া প্রতিনিধি :
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কাদিপুর শিববাড়ীকে বলা হয় সিলেট বিভাগের সবচেয়ে সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন মন্দির। প্রায় ১৫০ বছরের পরিক্রমায় এ বছরও এই শিববাড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। প্রাচীন কারুকার্যময় স্থাপত্যশৈলীর এক অপরূপ নিদর্শন কাদিপুর শিববাড়ি আকর্ষণ বাড়ায় সবার মনে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। পাঁচদিনব্যাপী এই উৎসব শেষ হবে আগামী ২ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।
২০২২ সাল থেকে শিববাড়িতে ২৩ ফুট উঁচু সহস্রভুজা (এক হাজার হাতের) দুর্গা প্রতিমার পূজা চলছে। ইতোমধ্যে শিববাড়িসহ উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) মো. আজমল হোসেন, কুলাউড়া থানার ওসি মো. ওমর ফারুকসহ সরকারসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সরেজমিনে শিববাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শিববাড়ির সৌন্দর্য রঙ-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রবেশমুখ থেকে বাড়ির ভেতর পর্যন্ত পাকা সাদৃশ্য একাধিক তোরণ রয়েছে। বাড়ির ভেতরে পাশাপাশি তিনটি মন্দির। ‘আনন্দ সেবাধাম’ নামের মন্দিরের দোতলায় ২০২২ সালে লাল রঙ দিয়ে এক হাজার হাতের দুর্গা প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছিল। সিমেন্টের তৈরি এই প্রতিমার উচ্চতা ২৩ ফুট। এরপর ২০২৩ সালে নতুন করে বড় দুটি মন্দিরের মাঝখানে তৈরি করা হয় “শ্রী শ্রী ভৈরবী মা” নামে আরেকটি মন্দির। গত বছরের মতো এবারও শ্রী শ্রী ভৈরবী মা মন্দিরের উপরে মানসী পূজাও করতে পারবেন পূজারীরা।
শিববাড়ির বাসিন্দা আচার্য্য পুলক সোম বলেন, প্রখ্যাত বেতার সম্প্রচারক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চণ্ডী পাঠের সময় দেবী দুর্গাকে কখনো দশভুজা, কখনো অষ্টাদশভুজা আবার কখনো সহস্রভুজা উল্লেখ করেছেন। মহিষাসুর বধের সময় দেবী যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তাতেও তিনি সহস্রভুজা ছিলেন। তাই লাল রঙ দিয়ে সহস্রভুজা দুর্গা প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। এটা চলবে প্রতিবছর। তবে প্রতিমার বিসর্জন হবে না।
পুলক সোম আরও বলেন, রঙ-তুলির ছোয়া শেষ হয়েছে, এখন পূজার সময়। এবার রাত ১২টার পর প্রধান ফটক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সবার সহযোগিতায় এবারও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পূজা উদযাপন করা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য শিববাড়ির বিভিন্ন স্থানে একাধিক সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, এই বাড়ির স্বর্গীয় অনঙ্গ কুমার সোম ছিলেন জমিদার বংশের। এই বংশের কোনো এক বংশধর তাঁদের দীঘিরপাড়ে বেলগাছের নিচে নিয়মিত শিবের সাধনা করতেন। সাধনা করলেও তখনো এ বাড়িতে কোনো শিবলিঙ্গ ছিল না। তাঁদের কুলদেবতা হচ্ছেন কানাই লাল (রাধাকৃষ্ণ)। পূর্বপুরুষগণ সম্পত্তির অনেকটা দেবোত্তর করে দিয়েছিলেন কুলদেবতার নামে। পরে অনঙ্গ কুমার সোমের পুত্র স্বর্গীয় অজিত কুমার সোমের পরবর্তী বংশধর পুলক সোমের সাধনায় ১৪০৫ বঙ্গাব্দে (১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ) শ্রাবণের ১৮ তারিখ শিবলিঙ্গটি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, শিবলিঙ্গটি ১৫০ বছর আগের। পরে পুরনো মন্দিরটি সংস্কার করে সেখানেই শিবলিঙ্গটি স্থাপন করা হয়। শুরু হয় প্রতি সোমবার সোমনাথ (শিব) পূজা। আসতে শুরু করেন ভক্তগণ। নিজেদের প্রার্থনা জানিয়ে শিবের পূজা শুরু হলে মন্দিরের উন্নয়নও শুরু হয় ভক্তদের আর্থিক সহায়তায়। তৈরি হয় অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির, যা ভক্তদেরকে আকৃষ্ট করে। ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের লাখো ভক্ত।
জানা যায়, শিববাড়ির পূর্বপুরুষদের জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটলে একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে প্রায় ৩১ বছর তারা দেবী দুর্গার ঘটপূজা করেন। তখন সেই বনেদী পূজা-পার্বণে আকাশছোঁয়া জৌলুস হারিয়ে গেলেও তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে একবিন্দু ঘাটতি পড়েনি। পরবর্তীতে ২০০১ সালে জমিদার বাড়ির মন্দিরটিতে জৌলুস ফিরতে শুরু করে, যা এখনও চলছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজায় লাখো ভক্তের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরটি।
কুলাউড়া উপজেলা পূজা উদযাপন ফ্রন্টের আহ্বায়ক বিধান দেব বলেন, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সর্বজনীনসহ মোট ২২১টি মণ্ডপে এবার শারদীয় দুর্গোৎসব হচ্ছে। এর মধ্যে শিববাড়িতে ভক্তদের সমাগম হয় সবেচেয়ে বেশি। শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপন করতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওমর ফারুক বলেন, উপজেলায় মোট ২২১টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপনে পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে বিট পুলিশিং, সর্বদলীয় নিরাপত্তা কমিটি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ করা হয়েছে। সবক’টি পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করা হয়েছে। পূজাকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের গুজব রোধে সবাই পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাচ্ছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, শিববাড়ি মন্দিরসহ উপজেলার প্রতিটি মণ্ডপে দুর্গাপূজায় সর্বশেষ প্রস্তুতি খুবই সন্তোষজনক। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন হবে। পূজা শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর করতে প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনী সম্মিলিতভাবে কাজ করছে।