জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ

- আপডেট সময় : ০৪:৫৯:৫৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩ ৭১ বার পড়া হয়েছে
স্টাফ রিপোর্টার:আজ সেই ভয়াল রাত।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চেও এই রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যা। সেই রক্তাক্ত ভয়াল রাত সেদিন আকাশকেও কাঁদিয়েছিলো।ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে তখন ঘুমিয়েও পড়েছে।গভীর হতে শুরু করেছে রাত। অকস্মাৎ যেন খুলে গেল নরকের সব দরজা।অপারেশন সার্চলাইট’। জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক নামল ঢাকার রাস্তায়। রাতের স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিন গান ও মর্টার। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস।মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক। এ রাতেই বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী।ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে ভয়ঙ্কর মাত্র এক রাতেই হানাদাররা হত্যা করেছিল হাজার হাজার ঘুমন্ত বাঙালীকে।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন-সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়,গ্রেফতার করা হয় আরও তিন হাজার লোককে।পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা।জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো।রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো।সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।২৫ মার্চ মধ্যরাতে অসংখ্য বাঙালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। শহরের রাজপথ, অলিগলি,ফুটপাথ, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্রই মৃত্যু রেখে গেছে তার করাল স্বাক্ষর।মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে এলো শহরের আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন আকাশে কেবলই মুহুর্মুহু আগুনের লেলিহান শিখা।মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে উঠল লাশের শহর। বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর, নির্মম ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ।
একাত্তরের এ দিনে ঘুমন্ত শিশু,বধূ, বৃদ্ধার রক্তে কলঙ্কিত হলো মানব ইতিহাস।সেই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান- হালাকু খানদের নৃশংস নির্মমতাকেও হার মানায়।নয় মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে।তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক-দালাল, রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনীর সদস্যরা।স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র নয় মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই। শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস্য হত্যাই নয়,বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পাননি ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে।শহরময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরার কারণে প্রথমেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) সামনের সাকুরার পেছনের গলিতে থাকা পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা অফিসে হামলা চালিয়ে গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
এরপর একে একে দৈনিক সংবাদ,ইত্তেফাক,জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ,মর্টার সেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা।এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও।ভয়াল রাতের পর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পাকি ট্যাঙ্ক,সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। চলতে থাকে অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। প্রতিটি রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। একে একে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ হিন্দু ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে।
ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্ত শকুনিরা শুধু হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি।সেই রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে।কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার কাজে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে।তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ মাটি চাপা দিয়েছিল পাক সেনারা।তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি।কাজ শেষে তাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়।সেদিন রাতে একযোগে জগন্নাথ হল ছাড়াও ইকবাল হল, রোকেয়া হলে শকুনির দল একে একে দানবের মতো হিংস্র থাবায় তছনছ করে দিয়েছিল।পাক জান্তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যেতির্ময় গুহ ঠাকুর, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
হানাদারেরা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ,গরিব মানুষকে। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুঁড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে।দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও একইভাবে অতর্কিতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক সেনারা।অবশ্য এই পরিস্থিতিতেও বাঙালী ছাত্র-জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।ঢাকার ফার্মগেইট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চারপাশে সর্বত্র এই প্রতিরোধ ছিল। প্রতিরোধ ছিল চট্টগ্রামেও।কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার মুখে সেদিন কিছুই করতে পারেননি অকুতোভয় বাঙালী। এদিকে,ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে শুভাকাঙ্খীরা তাঁর বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার অনুরোধ করেন।তাঁর জন্য হেলিকপ্টারও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।কিন্তু বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানী বাহিনী তাঁকে না পেলে একজন বাঙালীকেও বাঁচতে দেবে না।
সে রাতে তাঁকে না পেলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়া হতো পুরো শহর।ওই দিন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বললেন,মুজিব দেশের অখন্ডতা ও নিরাপত্তার ওপর আঘাত হেনেছেন। এ অপরাধের জন্য তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে।দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আজ আমি দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নিলেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো।রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক,সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।তখন বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীর বাঙালীর মতোই নিজেরই দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
রাত একটা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়।আর বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালী জাতির নেতা বঙ্গবন্ধুক গ্র্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল।২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন।গোপন ওয়্যারলেস বার্তায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেন,পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন।এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।