তরুণদের কারাতে-অস্ত্র প্রশিক্ষণের উদ্যোগ, কী বলছে সরকার
- আপডেট সময় : ১০:১৪:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫ ৫ বার পড়া হয়েছে
ভিউ নিউজ ৭১ ডেস্ক :
বাংলাদেশে প্রায় ৯ হাজার তরুণ-তরুণীকে আত্মরক্ষার নানা কলা-কৌশল এবং আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার এক নজিরবিহীন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা বলছেন, ভবিষ্যতে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাগরিকরা দেশের রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। দেশের ক্রান্তিকালে প্রয়োজনে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
নভেম্বর মাস থেকেই এই প্রশিক্ষণ শুরু হতে যাচ্ছে, এখন চলছে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করতে তরুণদের প্রশিক্ষিত করার জন্য এটি পাইলট প্রকল্প।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, আইডিয়াটা হচ্ছে গণপ্রতিরক্ষা বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশে। আমাদের সামরিক এবং ভৌগলিক বাস্তবতায় এটা আমাদের জন্য অপরিহার্য। সবসময় যে যুদ্ধ করতে হবে এমন নয়; কিন্তু তারপরেও একটা মোর্যাল থাকা যে রিজার্ভ ফোর্সের সংখ্যাটা বাড়ছে।
আসিফ মাহমুদ বলছেন, যে ভৌগলিক সামরিক অবস্থান বাংলাদেশের আছে, সেখানে গণপ্রতিরক্ষা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায় নাই।
তিনি বলেন, কারো যদি মৌলিক প্রশিক্ষণ থাকে, যে এটলিস্ট জানবে যে কীভাবে একটা অস্ত্র চালাতে হয়। তার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারলে দেশকে সার্ভ করতে পারবে।
দেশের ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি কেন্দ্রে ৮২৫০ জন তরুণ ও ৬০০ তরুণী ১৫ দিনের এই আবাসিক প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে। ১৮-৩৫ বছর বয়সী বাংলাদেশের নাগরিকরা আবেদন করতে পারবে।
কীভাবে প্রশিক্ষণ হবে
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে একে আত্মরক্ষামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ বলা হচ্ছে। যেখানে জুডো, কারাতে, তায়কোন্দ এবং শ্যুটিং বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে বিকেএসপির সাতটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এই আবাসিক প্রশিক্ষণ হবে। ১৫ দিনের এই প্রশিক্ষণ শেষে ৪২০০ টাকা ভাতা এবং থাকা খাওয়া ও পোশাক দেওয়া হবে।
তরুণ তরুণীদের জুডো কারাতে তায়কোন্দ এবং শ্যুটিংয়ের মৌলিক প্রশিক্ষণ কেবল আত্মরক্ষাই নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতে রিজার্ভ ফোর্সের বৃদ্ধির কৌশল বলে বলছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা।
তিনি আরও জানান, এই প্রশিক্ষণে সরাসরি বুলেট ফায়ারিং শেখানোর ইচ্ছা থাকলেও গুলির অনুমোদন, বাজেট ও অবকাঠামো জটিলতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।
তরুণরা অস্ত্র হাতে কী ধরনের প্রশিক্ষণ পাবে- এ প্রশ্নে আসিফ মাহমুদ বলেন, গুলি ছোড়া বাদে অস্ত্র চালানোর সবকিছুই শেখানো হবে। ফায়ারিংয়ের থিওরিটিকাল দিকটা শেখানো হবে একই সঙ্গে প্রাকটিক্যাল দিকটাও শেখানো হবে।
তিনি বলেন, এইম করা, তারপর পজিশনিং করা, ফলো থ্রু করা, তারপর ট্রিগার করা। তবে সরাসরি ফায়ারিং করাটার অনুমতি সংক্রান্ত অনেকগুলো বিষয় আছে, আমাদের অ্যামুনেশন লাগবে সবকিছু মিলিয়ে ওইটাতে আমরা এখনই যেতে পারছি না। তবে ভবিষ্যতে আমার মনে হয় যে আরো বড় পরিসরে করার সুযোগ এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে।
এই প্রশিক্ষণ কেন প্রয়োজন এ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, গণপ্রতিরক্ষার আইডিয়া থেকেই তার মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে সচেতন করা এবং ন্যুনতম প্রশিক্ষণ দেওয়াটাই উদ্দেশ্য। যদি কখনও সেরকম পরিস্থিতি আসে বাংলাদেশে সংকটময় মুহূর্ত আসে মানুষ যাতে ঝাপিয়ে পড়ে।
আমার মনে হয়েছে যে দেশে যদি কখনও সিকিউরিটি ক্রাইসিস হয় এবং আমাদের যে ভৌগলিক বাস্তবতা সেটা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। পৃথিবীতে আমরা ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজায় যুদ্ধ দেখেছি। কথায় কথায় যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে। প্রস্তুতি থাকতেতো সমস্যা নাই।
ভবিষ্যতে অবকাঠামো এবং বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে প্রতিবছর কমপক্ষে বিশ হাজার যুবকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বলে জানান যুব ও ক্রীড় উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সরাসরি গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণদের প্রশিক্ষিত করা দরকার।
‘লাইভ রাউন্ড ফায়ারিং পর্যন্ত শেখানো যায়, তাহলে আমার মনে হয়, এটা গণপ্রতিরক্ষার জন্য, জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি হবে। ইয়ারলি বিশ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দিতে পারি তাহলে এটাও আমাদের জন্য বড় অর্জন হবে। দশ বছরে ট্রেইন্ড ফোর্স বেড়ে যাচ্ছে দুই লক্ষ্য। যেটা হিউজ। এবং এটা রিজার্ভ ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হবে’ বলেন, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
‘আগ্নেয়াস্ত্র’ প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্বেগ
সাধারণ নাগরিকের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণের বিষয়টি স্পর্ষকাতর। এছাড়া বিশ্বব্যাপী তরুণ ও সিভিলিয়ানদের অস্ত্র-গুলি থেকে দূরে রাখার ব্যাপারে সোচ্চার অনেকে। ক্রীড়া উপদেষ্টা তার ফেইসবুক পেইজে চারধরনের প্রশিক্ষণের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
যদিও বলা হচ্ছে, সরাসরি গুলি চালানো শেখানো হবে না, তারপরও অস্ত্র সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান থাকলে সেটিও উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। এছাড়া ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে এই কার্যক্রম সেদেশের জাতীয় কৌশল ও নীতির আলোকে হয়। বাংলাদেশে এ প্রকল্পে সেরকম কোনো জাতীয় কৌশল বা নীতি অনুপস্থিত।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন দেশে যে প্রশিক্ষণ আছে, সেটার ব্যাপারে একটা ডিটেইল ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি আছে। যেটা কোনো মন্ত্রণালয় করে না। সেটা দেশের পার্লামেন্টে পাস করে একটা নীতিমালা করা হয়। খুবই বিষদভাবে এটা করা হয়। কাজেই সে ধরনের কোনো জাতীয় কৌশল নীতি আমাদের কাছে নাই।
‘এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে একটি মন্ত্রণালয়ের ধারণা থেকে এটা আসছে, কাজেই কোনো জাতীয় নীতিমালা আছে বলে আমি মনে করছি না। এ ধরনের কার্যক্রম জাতীয় নীতিমালা ছাড়া করা যায় না। কারণ এর সঙ্গে স্পর্শকাতর জিনিসপত্র জড়িত থাকে, জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত থাকে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ভাল হতে পারে বা খারাপও হতে পারে।’
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটা অবনতি লক্ষ্য করা গেছে। আন্দোলনের সময় লুট হওয়া পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বহু অস্ত্র-গুলি এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতি ধরা পড়ছে। এরকম একটা অবস্থায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ কারা পাবে এবং সেটি কীভাবে তারা কাজে লাগাবে সেই সন্দেহ থেকেই যায়।
মুনীরুজ্জামান বলেন, কী ধরনের লোক এখানে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড যদি চেক করা না হয়, তাহলে হয়তো ভুল কিছু লোক প্রশিক্ষণ পেয়ে যেতে পারে। যদি ভুল কিছু লোক প্রশিক্ষণ পেয়ে যায়, তারা প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরে সেটা যদি অন্যকাজে ব্যবহার করে, তাহলে দেশের জন্য ভালোর চাইতে খারাপ হয়ে যাবে।
তরুণ শিক্ষার্থীরা কী বলছেন
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকের বিষয়টি সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা নেই। কেউ কেউ বলছেন, প্রশিক্ষণ বিষয়ে পরিস্কার করে তথ্য দেওয়া হয়নি।
সায়মা তাসনীম নামে একজন বলছেন, আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ জরুরী।আমার কাছে মনে হয়েছে ট্রেনিংটা দরকার। এবং আমিও বেশ আগ্রহী। এই নিউজটা ভালভাবে প্রচার হয়নি। আমি প্রচুর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি আমি নিজে জানি না। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মেয়েদের জন্য এটা খুবই দরকার। কারণ আমরা জানি সাম্প্রতিক সময় রেপ অনেকটা বেড়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঝুঁকির দিক তুলে ধরে বলেন অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে অবৈধ অস্ত্রের কারবার বেড়ে যেতে পারে।
তার মতে- যেহেতু অস্ত্র চালানোর একটা প্রশিক্ষণ আছে আমার তখন লিগ্যালের বাইরে অবৈধ একটা মাফিয়া গড়ে উঠবে যে কীভাবে অস্ত্র সাপ্লাই দেওয়া যায় বা আমি কীভাবে অবৈধ অস্ত্রটা কিনতে পারবো। কারণ বাংলাদেশে মোটামুটি কোনো কিছু লিগ্যালি করা অনেক প্রসেসের মধ্যে অনেক ঝামেলার মধ্যে যেতে হয় বা অনেক সময় দামও বেশি থাকে। তো ওই যায়গা থেকে দেখা যাবে যে অবৈধ কাজকর্ম অনেক বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ থেকে বাইরে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনে যুক্ত হওয়ার নজির রয়েছে। নানা বিচার বিশ্লেষণ থেকে সাধারণ নাগরিকদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণের ঝুঁকির কথা বলছেন শিক্ষার্থীরাও।
প্রান্ত নামে একজন বলেন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ যে তরুণরা, তারা সবাই চায় তার দেশকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে আমরা অস্ত্র ট্রেনিং নেওয়ার মতো ওই যে মানসিক ম্যাচিউরিটি ওই অবস্থাতে আমরা নাই।
























