অযত্নে ধুঁকছে পল্লী-কবি জসীমউদ্দীন জাদুঘর

- আপডেট সময় : ০২:৫৮:১৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫ ২৯ বার পড়া হয়েছে
ভিউ নিউজ ৭১ ডেস্ক :
ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুরে কবির বাড়ি সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত পল্লীকবি জসীমউদ্দীন জাদুঘর ও লোক সাংস্কৃতিককেন্দ্র। এ জাদুঘর ও সাংস্কৃতিককেন্দ্রটিতে সরকারি লোকবল থাকলেও দর্শনার্থীদের নেই তেমন আনাগোনা। সেই সঙ্গে প্রচার-প্রচারণার অভাব, জাদুঘরের প্রবেশদ্বার কবির বাড়ি থেকে একটু দূরে, জাদুঘরের ভেতর কবির নিদর্শন-স্মৃতিচিহ্নের অভাব, দর্শনাথীদের জন্য নেই কোনো বসার স্থান, ফুলগাছসহ অন্য গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে মরার উপক্রম, জাদুঘরের দেওয়াল ও কলামে নোনা (ড্যাম্প) ধরে রং খসে পড়ছে। এসব কারণে দর্শনার্থীশূন্য হয়ে পড়েছে এ জাদুঘর ও লোক সাংস্কৃতিককেন্দ্রটি। নানা সমস্যায় জর্জরিত জাদুঘরটি অচিরেই পুরোদমে সচল করার দাবি দর্শনার্থী ও স্থানীয়দের।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন জাদুঘর ও লোক সাংস্কৃতিককেন্দ্রটি ফরিদপুর শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার উত্তরে সদর উপজেলার অম্বিকাপুর গ্রামে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি সংলগ্ন কুমার নদের তীরে অবস্থিত। এটি সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা। জাদুঘরের ওই প্রকল্পটি গ্রহণ করে ২০০৬ সালে এবং ২০১৪ সালে শেষ হয়। এরই মাঝে ২০১১ সালের ২১ জানুয়ারি তৎকালীন তথ্য ও সাংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ প্রধান অতিথি হিসাবে এ জাদুঘর ও সাংস্কৃতিককেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন। ফরিদপুর গণপূর্ত বিভাগ ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি হস্তান্তর করে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন জাদুঘর ও লোক সাংস্কৃতিককেন্দ্রটি ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। একই বছরের ৯ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলক দর্শকদের জন্য গ্যালারি খুলে দেওয়া হয়, যা অদ্যাবধি চালু রয়েছে। জাদুঘরটি চার একর জমির ওপর নির্মিত। জাদুঘরে মোট ৪টি ভবন রয়েছে। গ্যালারি ভবন, অফিস ভবন, লাইব্রেরি ভবন, ও ডরমেটরি ভবন। তাছাড়া পল্লীকবি জসীম উদ্দীন রচিত ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা আয়োজনের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব পাশে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ রয়েছে। গ্যালারিতে প্রদর্শিত নিদর্শন সংখ্যা প্রায় ১৬০টি। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কবির ব্যবহারের খাট, টেলিফোন, দুর্লভ ছবি, বিছানার চাদর, নকশিকাঁথা, কবিতা ও সাহিত্যের পান্ডুলিপিগুলো।
এরপরও কবির ব্যবহার্য স্মৃতিচিহ্ন, দুর্লভ ছবি, অনেক নিদর্শনসহ অনেক কিছুই রয়ে গেছে কবির বাড়িতে তাদের পরিবারের নিজস্ব সংগ্রহে। এগুলো কবি পরিবারের কাছে সরকার ও জাদুঘরের পক্ষ থেকে বিগত দিনে চাইলে তারা তা দিতে অনেকটা অনাগ্রহ প্রকাশ করে। স্থানীয় লোকমুখে শোনা যায়, জাদুঘর সংলগ্ন অম্বিকাপুরে কবির বাড়িটি কবরস্থানসহ প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা রয়েছে। এর বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক দেড় থেকে দুই কোটি টাকা হতে পারে। কিন্তু কবির ব্যবহার্য কিছু জিনিসপত্রসহ অতিতে একসময় বাড়িসহ তার স্মৃতিচিহ্ন ২৮ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু তাতেও প্রয়াত কবির পরিবারের সবাই একমত হতে না পারায় সেটি অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
রাজবাড়ী জেলা থেকে জাদুঘর দেখতে আসা কলেজ শিক্ষার্থী রবিউল ও শওকত বলেন, জাদুঘরটি দেখতে এসে নিরাশ হওয়া ছাড়া তেমন কোনো কিছুই দেখছি না। ২০ টাকার বিনিময়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে দেখি নেই কোনো বসার স্থান। পানি কিংবা হালকা খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। পল্লীকবির নামে জাদুঘরটিতে তার ব্যবহার্য আরও বেশি কিছু থাকবে এটাই আশা করেছিলাম। কবির লেখা কোনো বই কেনার ব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে আমরা হতাশ হয়েছি।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন মো. লিটন। তিনি বলেন, বাসস্ট্যাান্ড থেকে অটোরিকশায় এসে কবির বাড়িতে নেমেছি। সেখানে জনপ্রতি ২০ টাকার বিনিময়ে টিকিট কেটে জসীম উদ্দীনের পারিবারিক কবরস্থান ও বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে কবির ব্যবহার্য অনেক কিছুই দেখেছি। কিন্তু কবির বাড়ির পাশেই যে জাদুঘর আছে তা জানি না। সেখানে কবির কি কি আছে গিয়ে দেখব।
জসীম উদ্দীন জাদুঘর সূত্রে জানা যায়, চার একর জমির ওপর নির্মিত জাদুঘর ও লোক সাংস্কৃতিককেন্দ্রে ৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে চারজন স্থায়ী, বাকিরা মাস্টাররোলে চাকরি করেন। স্থায়ীদের মধ্যে একজন মিউজিয়াম ইনচার্জ, একজন নারী স্টাফ, অন্যরা রিসিপশন ও জাদুঘরের মধ্যে নিরাপত্তায় কাজ করেন। এছাড়া জাদুঘর সীমানার অভ্যন্তরে নিরাপত্তায় ৬ জন আনসার সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে একজন বাবুর্চির কাজ করেন। অনেক সময় একজন ছুটিতে থাকেন। মাত্র ৪ জন আনসার সদস্য শিফট ভাগ করে নিরাপত্তায় কাজ করে থাকেন। এখানে বাগান পরিচর্যায় কোনো মালি নেই। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের স্মৃতি রক্ষার্থে জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে কবির বাড়ির সঙ্গে এ জাদুঘরটি স্থাপিত হয়েছে।
কবিপুত্র মরহুম ড. জামাল আনোয়ারের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা বলেন, আমার স্বামী ড. জামাল আনোয়ার মারা যাওয়ার পর কবির বাড়ি সংলগ্ন বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একজন নারীর পক্ষে তদারকি ঠিকমতো করা কঠিন। তাই কবির বাড়ি সংলগ্ন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ও সরকার যদি সমঝোতার মাধ্যমে এ বাড়ির দায়িত্ব নিত, তাহলে ফরিদপুরবাসীসহ কবিভক্ত সবার জন্য ভালো হতো। এতে দুটি জায়গা মিলে এবং কবির সব নিদর্শন দিয়ে কবিভক্ত এবং দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা বেশি উপভোগ করতে পারত।
এ বিষয়ে জসীম উদ্দীন জাদুঘরের ইনচার্জ মুকেশ চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, আমাদের জাদুঘর ও সাংস্কৃতিককেন্দ্রটি জসীম উদ্দীনের বাড়ির পাশে এবং পেছনে। এছাড়া জাদুঘরে প্রবেশের গেটটি একটু দূরে, তাই অনেকে এখানে আসেন না। তাছাড়া যারা পিকনিক, দলবদ্ধ ভ্রমণ কিংবা শিক্ষা সফরে আসেন তারা কবির বাড়িতে ২০ টাকার বিনিময়ে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করে তারপর অর্থ সংকটে এখানে (জাদুঘর) এসে প্রবেশ করতে চান না। তারপরও আমরা তাদের কিছুটা ছাড় দিয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়ে থাকি। দর্শনার্থীরা অন্তত জসীম উদ্দীন সম্পর্কে জানুক এবং তার নিদর্শন দেখুক এটা আমরা চাই।